পাথেয়

 

ভূমিকা–সলিমুল্লাহ খান

 

মহাত্মা আহমদ ছফা সাহিত্য ব্যবসায়ের প্রথম পর্বে ছোট গল্পে হাত পাকাইতেন। তাহার পাথুরে প্রমাণ ‘পাথেয়’ নামধেয় বর্তমান গল্পটিতেও পাওয়া যাইতেছে। যতদূর জানি এই গল্পটি আহমদ ছফা রচনাবলির হাল সংস্করণে স্থান পায় নাই। তাঁহার একটি কারণ এই হইতে পারে যে আহমদ ছফার একমাত্র ছোটগল্প সংকলন ‘নিহত নক্ষত্র’ নামক পুস্তকে ইহা লওয়া হয় নাই।

‘পাথেয়’ প্রথম ছাপা হইয়াছিল ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি তারিখে প্রকাশিত ‘হে স্বদেশ’ সংকলনের ‘গল্প’ খণ্ডে। একই তারিখে একই নামে আরও দুইটি খণ্ড — যথাক্রমে ‘প্রবন্ধ’ ও ‘কবিতা’ — প্রকাশিত হইয়াছিল। তিনটা খণ্ডেরই প্রকাশক বাংলা একাডেমি (তৎকালের বানান অনুযায়ী লিখিতে ‘বাঙলা একাডেমী’)। ‘হে স্বদেশ’নামা এই তিন সংকলনেরই প্রচ্ছদ আঁকিয়া দিয়াছিলেন মহাত্মা জয়নুল আবেদিন। খবরটি বলিয়া রাখা বাহুল্য নয়। তিন সংকলনেরই পটভূমিকায় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই সকল সংকলনের প্রবর্তনা করিয়াছিলেন মহাত্মা আহমদ ছফা। তিনি ছিলেন সেকালের ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’ নামক সংগ্রামী সংগঠনের অগ্রগণ্য নেতা।

‘পাথেয়’ গল্পের বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে দিন গণহত্যা শুরু করিয়াছিল তাহার দুয়েকদিনের মধ্যেই সারাদেশ হইতে নিপীড়িত মানুষ প্রাণ হাতে করিয়া দেশ ছাড়িতেছিল। দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা হইতে এইরকম বিতাড়িত মানুষের একটি দল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা পানে ছুটিয়া চলিয়াছে। সেই পথুমতি মানুষের মিছিলে হাজারো কাতর ভীতসন্ত্রস্থ অসহায় মানুষের দলে সেদিন ছিলেন গর্ভবতী আসন্নপ্রসবা একজন জননীও। পথিমধ্যে তাহার প্রসববেদনা দেখা দিল। সেকালের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তঃপাতী তিতাসনদীর পাড়ে এক জায়গায় জননী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। এই নবজাতকের জন্মের দৃশ্যটি আহমদ ছফা পাকাহাতে আঁকিয়াছেন। শরণপথগামী মানুষের কঠিন শোভাযাত্রা ক্ষণিকের জন্য থামিয়াছিল তিতাসের পাড়ে। নবজাতকের আগমন সম্পন্ন হইলে পর মিছিল আবার আগাইয়া চলে।

আমাদের মনে হইয়াছে এই ছোটগল্পে আহমদ ছফা বাংলাদেশের জন্মকাহিনীটি একপ্রস্ত রূপকথার আদলে বলিয়াছেন। ছোটগল্পের অঙ্গে তিনি রূপক বা এলেগরির অঙ্গরাখা চাপাইয়া দিয়াছেন। আমি কোন এক নিবন্ধে এই গল্পের পরিচয় দিয়াছি ‘নতুন জাতির জন্ম’ নাম আরোপ করিয়া।

 

২৭ নবেম্বর ২০১৩

 

ছবি: রঘু রায়

ছবি: রঘু রায়

মানুষের স্রোতটা এঁকেবেঁকে আলপথ ধরে, বোরোক্ষেতের উপর দিয়ে, ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে, চৌদ্দ পুরুষের বাস্তুভিটের মায়া কাটিয়ে শিকারীতাড়িত একপাল ভীতসন্ত্রস্ত পশুর মতো পালিয়ে আসছে। যতই সামনে যায় সংখ্যা বাড়ে। একটু জিরোয় মাঝে মধ্যে। জিরোয় না, আত্মীয়স্বজন মাবাপ ছেলেমেয়ে কে এলো, কে এলো না, কে জন্মের মতো গেলো ভাবতে চেষ্টা করে। গুলিগোলার আওয়াজ আর আত্মীয়স্বজনের টাটকা লাল রক্তের স্মৃতি আবার তাড়া করে। মানুষগুলো আবার হাঁটে — সোজাপথে নয়, বাঁকাচোরা ঘুপচিঘাপচি জংলাপথ বেছে নেয়। প্রাণের মায়া বড়ো মায়া। দুঃখের কথা কয়ে লাভ নেই, কষ্টের কথা বয়ান করে লাভ নেই। চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির জন্য চোখের জল ফেলে কি হবে! সব তো গেছে। এখন প্রাণ নিয়ে চলো। মানুষগুলো পা চালায়। কেউ কাউকে তাড়া দেয় না। কোথায় যাবে কোন পথ দিয়ে যাবে কারো কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। শুধু জানে বর্ডার পেরিয়ে আগরতলায় ঢুকতে হবে। তারপরে কি হবে, কি হবে তারপরে? কেউ কিছু জানে না। সব অদৃষ্ট! অদৃষ্টের ফের!

অনেক ঘুরে মানুষগুলো রেলের লাইনের উপর উঠলো। সামনে আটদশজন লাইনে উঠেই থমকে দাঁড়াল। লাইনের উপর দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা জানার জন্য পেছনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, কি, অ কি ক’ যামুনি? পেছনের আটদশজন প্রায় একসঙ্গে জবাব দিলো ‘হ যাওন যাইবো, দুই দিকের পুল ভাঙা।’ তারপরে নিঃশব্দে মানুষের মন্থর আধমরা স্রোতটা রেলের লাইনের উপর উঠে এলো। আকাশে চড়চড়ে রোদ। প্রসারিত মাঠে অল্প অল্প বাতাসে কচি পাটের চারা দুলছে। বোরো ধানে সোনার বরণ ধরেছে। উঠতি বেলায় রোদের ধার ছিলো খুব। এখন তেজটা মরেছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া দিচ্ছে।

ছবি: রঘু রায়

ছবি: রঘু রায়

নবীনগর থেকে শেয়ালের মতো একবেলার পথ দু’দিনে হেঁটে পাগাচং ইস্টিশানের কাছে এসেছে। রোদে আধাপোড়া হয়েছে সকলে। তেষ্টায় অনেকেরই বুক জ্বলছে। কতো গেরাম, কতো পাড়া, কতো দীঘি, কতো পুকুর পেরিয়ে এলো — এক আঁজলা জল চাইতে পারেনি। পাড়ায় পাড়ায় ডাকাত লুকিয়ে আছে। মানুষ ভারী বেরহম। একদল মারে, আরেকদল কেড়ে রাখে শাড়িগামছা পর্যন্ত। উঠতি বয়সের মেয়ে থাকলে লুটে নিয়ে যায়। বিপদ বড়ো বিপদ। জন্মভূমির সবকিছুই শত্র“তা করছে। কালচে জলের লম্বা বাঁকা গাঙের কাছে আকুল তেষ্টা নিয়ে আঁজলা পেতে দাঁড়াও, গাঙ জল দেবে না।

হাওয়াটা বড় প্রাণ ঠাণ্ডা করা। রেলের লাইনের উপর দাঁড়িয়ে একজন বুড়ো মানুষ ধুতির খুটে চোখ মুছতে মুছতে ডুকরে কেঁদে উঠলো ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে। ছাওয়ালডারে জন্মের মতন রাইখ্যা আইলাম। ভগবান, তুই দয়ার সাগর। কান্না জিনিসটেই সংক্রামক। আরেকটি মেয়েছেলে। সারাপথে কারো সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। তার আমের আঁটির মতো শুকনো মুখে ঢেউ খেলে গেলো। প্রথমে ফুঁপিয়ে তারপর গলা ছেড়ে কেঁদে উঠে। ও ভাই প্রাণহরি, তুই ছাড়া থাকুম কেমনে রে! আরেকজন গলায় কণ্ঠিপরা আধবয়সী, রাধাকৃষ্ণের ভক্ত, কণ্ঠস্বরে দরদ ঢেলে বললো, চুপ করো মা, সব ঠাকুরের ইচ্ছে। কিন্তু গোটা দলটির মধ্যে তখন কান্নার রোল পড়ে গেছে। সকলেই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে। বাপ, ভাই, স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন। আচার্যপাড়ার কালীকিঙ্করের মার তিনকুলে কেউ নেই। বুড়ি সারা পথ ভ্যানর ভ্যানর করেছে। একে ডেকে, তাকে ডেকে জিগগেস করেছে। আঁরে সেখানে ভাত দিব রে — দূর থালাবাটিটাও ফেইল্যা আইলাম। পোড়াকপাল, দুইমুঠ ভাত দিলেও খামু কিসে কইর‌্যা। তপনবাবুর বাড়িতে আগুন জ্বইলা উঠল, সকলের নগে আমি বার অইয়া আইলাম।

বুড়ির কথার কেউ জবাব দেয়নি। বুড়িও চুপ মেরে গিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপরে অন্যকথা তুলেছে। সেখান ভালো তরকারী পাওয়া যায় কিনা। খাওয়ার ভারী লোভ রমণীর মার। বিধবা হলে কি হবে। একটা চ্যাঙড়া বয়সের ছেলে একটা ধমক দিয়েছে। মাইনসের প্রাণ বাঁচে না, তোমার খাই খাই। দেমু নিহি একডা ধাক্কা। তারপর বুড়ি সারাপথ নিজে নিজে আকাশের দেবতাকে অভিশাপ দিয়েছে। বিকেলবেলায় রেলের লাইনের উপর সকলকে কাঁদতে দেখে বুড়ি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ব্যাপারটা কি প্রথমে আঁচ করতে পারেনি। তারপর ঘোলা ঘোলা চোখ দু’টো একটু কচলে নিয়ে ডানহাতের লাঠিটা বাঁহাতে বদল করে মুখটা বিকৃত করে — অ বাপ রমণীরে বলে বহুকাল আগে স্বর্গগত রমণীর নাম ধরে কান্না জুড়ে দিলো। একটা বৌ দু’দিন আগে তার প্রথম ছেলে হারিয়েছে। স্তন দু’টো ফুলে উঠেছে, যন্ত্রণায় টনটন করছে — সে শুধু পাথরের মতো নির্বাক হয়ে রইলো।

মানুষগুলো সামনে যাচ্ছে। দেশগেরামের স্মৃতিচিহ্ন অন্তর থেকে মুছে ফেলেছে, জন্মভূমির ছবি দৃষ্টি থেকে মুছে ফেলেছে। চারদিকে মৃত্যু জাল পেতেছে। তারই মধ্য দিয়ে তারা হাঁটছে। কান পাতলে শোনে কামানের গর্জন। চোখ মেললে আগুনের শিখা দাউ দাউ নাচে, আত্মীয়স্বজনের রক্ত লাল হয়ে জেগে থাকে। তবু প্রাণের দায়। মানুষগুলো হাঁটছে। চারদিক থেকে বৃত্তাকারে লোহার সাঁড়াশীর মতো ভয়ঙ্কর মৃত্যু, করুণ পাইকারী মৃত্যু দ্রুত তাদের ঘিরে ফেলছে। তাই তারা যাচ্ছে ভিটেমাটি ছেড়ে, দেশগেরাম ছেড়ে, মাতৃভূমির আঁচল ছেড়ে, নাড়িকাটা ভূমি ছেড়ে। জীবন ভারী সুন্দর। বড়ো মধুর এই বেঁচে থাকা। কোথায় জীবনের উপর মেলে দেয়া সে শান্তসুন্দর ছায়া!

দলের মধ্যে একটি মেয়ে ফিসফিসিয়ে আরেকটি মেয়েকে কি বললো। দু’জন পেছন ফিরে চাইলো। মেয়েদের মধ্যে কথাটা চাউর হয়ে গেলো। সকলেই পেছনে ফিরে ফিরে সে লোকটাকে দেখলো। মেয়েদের দেখাদেখি পুরুষেরাও তাকিয়ে তাকিয়ে সেই কালো লম্বা মানুষটাকে দেখলো। কোন ঘৃণা, কোন বিদ্বেষ, কোন নালিশ নেই কারো। দলের মধ্যে সকলের মুখে মুখে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হতে থাকলো, গত রাতের সেই লোকটা। মানুষের বিস্ময়বোধ কখনো ফুরোয় না। কৌতূহল এবং বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েও মানুষটাকে দেখতে লাগলো সকলে। যেন লম্বা কালো মানুষটার দেশ ছেড়ে যাওয়ার অধিকার নেই। এই দলটি এক সঙ্গে একটি স্কুলঘরে রাত কাটিয়েছে। লোকটিও সঙ্গে ছিলো। গভীর রাতে হরিচরণ কুমোরের বড়ো মেয়েটাকে বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। বোধ হয় আতঙ্ক, বোধ হয় ভয়ের কারণেই হবে, ধুমসী কালো অনেকদিন ধরে বিয়ে না হওয়া মেয়েটা চিৎকার করে উঠেছিল। সকলে জেগে উঠলে সে লোকটা ভদ্রভাবে সে রাতের মতো কোথায় সরে পড়েছিল। তার সম্বন্ধে কেউ কিছু জানে না, কার ছেলে, কার নাতি, কোথায় ঘর। এখন লোকটা পেছনে পেছনে দলের সঙ্গে আসছে, তার লম্বা ছায়াটা লাইনের উপর পড়েছে। এটাই বিস্ময়ের কারণ।

মানুষের স্রোতটা লাইন বেয়ে ভাতশালা ইস্টিশানের কাছে এসেছে। ইস্টিশান মাস্টারের ঘর বন্ধ। মানুষজনের নামগন্ধ নেই। দিগন্তরেখার ধার অবধি বিস্তৃত রোদ ঝলকানো গোটা বাংলাদেশ মৌন নিস্তব্ধ। বাতাসে শ্বসিত হচ্ছে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস। একটাই দৃশ্য। মানুষ পালাচ্ছে রেলের লাইন ধরে। দাবানল জ্বলে উঠা বন থেকে উর্দ্ধশ্বাসে প্রাণভয়ে পশুরা যেমন পালায় দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে — তেমনি করে।

গুবরেপোকার ডাকের মতো একটানা একটা আওয়াজ ভেসে আসে। খুবই ক্ষীণ আওয়াজ। এ চারপাঁচ দিনের মধ্যে মানুষ গুলোর শ্রবণশক্তি অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একজন দু’জন কান খাড়া করে রইলো। বোঁ বোঁ একটানা গুঞ্জন, তারপরে পিট পিট শব্দ। আধবয়েসী একজন মানুষ ঘাড়টা কাত করে কান দু’টো ভালো করে পেতে নিশ্চিন্ত হলো। তারপর বললো, আমার মনে লয় বাওনবাইরা ভৈরবের দিকে পেলেন লইয়া গুলি অইতাছে। কথাটা গোটা দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। সকলে উত্তরপশ্চিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপার কি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেলো লাইনের উপর। সত্যি সত্যি চারটি এরোপ্লেন দেখা গেলো। প্রথমে চারটি সাদাবিন্দুর মতো দেখাচ্ছিলো। নীচের দিকে নামলে সমস্ত গতরটা দেখা গেলো। বোঁ বোঁ চক্কর দিয়ে ঘুরছে। প্যাট প্যাট করে মেশিনগানের গুলি ফুটছে। একবার ওপরে উঠছে আবার শিকারী বাজের মতো ছোঁ মেরে নীচে নামছে। মাঝে মাঝে দ্রƒম দ্রƒম শব্দ হচ্ছে — ওগুলো বোমা।

আতঙ্কিত মানুষগুলো আবার পা চালিয়ে দিলো। আকাশ থেকে মৃত্যু ছুঁড়ে দিলো পাকিস্তানী সৈন্য। বেশী দূর যেতে হলো না। যে সমস্ত মানুষ জন্মের জন্য দায়ী নয় — অথবা রাজনীতির জন্য দায়ী নয়, অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে মুসলমান এবং দেশের হালচাল নিয়ে মাথা ঘামায়নি, মাটি, নরম জলে ভেজা বাংলাদেশের মাটি গাছের মত আঁকড়ে ছিল তারাও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে গরুবাছুর, ধানচাল, কাঁথাবালিশ হাতের কাছে যা পেয়েছে নিয়ে দলে দলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাসাভাঙ্গা পাখীর মতো বেরিয়ে, বিল মাড়িয়ে রেলের লাইনের দিকে ছুটে আসছে। ভাতশালার কাছেই ওদের সঙ্গে নবীনগর থেকে আসা মানুষদের সাক্ষাত হলো। একজন জিগগেস করলো, কি, অ ভাই সাব হবর কি! লোকটি একটি কালো ছাগলের দড়ি ধরে টানতে টানতে বললো, হারে ভালা না ভাই, আর সুখ নাই। পাঞ্জাব্যায় সৈন্য উজানীশর পুলের ঐ পাড়ে আইয়া পড়ছে। পুল ভাঙ্গা নইলে বাওনবাইরা এক দৌড়ে চইল্যা যাইব। জবর যুদ্ধ অইব, মুক্তিফৌজও এই পাড়ে কাইল থুনে পজিশন লইয়া রইছে।

তার দশ মিনিটও অতীত হয়নি। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কামান গর্জন করে উঠে। ধোঁয়া দেখা যায়, আগুনও দেখা যায়। রাইফেলের গুলির শব্দ আসে। উজানীশরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। দু’পক্ষে অবিরাম গোলাগুলি চলছে। পাকিস্তানী সৈন্যের ছত্রিশ পাউন্ডার কামানগুলোর আওয়াজ কানে তালা ধরিয়ে দেয়। মানুষগুলো থমকে দাঁড়ালো। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্লেন থেকে বোমা ফেলছে, মেশিনগান দিয়ে নিরীহ মানুষের উপর গুলি ছুঁড়ছে। সামনে লড়াই চলছে। সামনে পিছে দুই দিকেই মৃত্যু। মানুষজন বিলের উপর দিয়ে পিঁপড়ের মতো ঝাঁক বেধে ছুটে আসছে রেলের লাইনের দিকে। দুঃসময়, প্রচণ্ড দুঃসময়, সমস্ত বাংলাদেশের উপর দুঃসময় নেমে এসেছে। যে যেখানে আছো ছুটে পালাও। যেভাবে পারো জান বাঁচাও। মানুষের জান এখন ভারী সস্তা। প্রাণের প্রতি পাকিস্তানী সৈন্যের ভয়ঙ্কর দৃষ্টি। যা কিছু প্রাণের আবেগে নড়েচড়ে দেখে দেখে তাক করে গুলি ছুঁড়বে।

রেলের লাইনের উপর দাঁড়িয়ে মানুষগুলো দেখে দক্ষিণপশ্চিম কোণে আগুনের লালশিখা কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে। বাতাসে খোলাজিহ্বা প্রসারিত করে বাংলাদেশের আকাশে ডাকিনীযোগিনীর মতো নেচে বেড়াচ্ছে ঘৃণাবিদ্বেষের কালো ধোঁয়া আর রোষের তাজা আগুন। কিছুই বাঁচবে না শিশু বুড়ো নারী পুরুষ। আগুনে পুড়ে ঝলসিয়ে যাবে। গুলিতে মরবে। কামানের গোলার আগুনে ধড় থেকে মুণ্ডু উড়ে যাবে। গরুবাছুর জ্বলে অঙ্গার হয়ে পড়ে থাকবে। ফলবান গাছ নীরব সহিষ্ণুতায় আগ্নেয় প্রহার বুকে ধারণ করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাংলাদেশে মানুষ নামের কোনো জীব থাকতে পারবে না। কেবল থাকবে মিলিটারী। বুটজুুতোর আওয়াজ নরম পাললিক মাটিতে গেঁথে গেঁথে ওরা টহল দেবে। বাংলাদেশের বাতাসে ওদের গাড়ীর পেট্রোলের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কোনো সুবাস পাওয়া যাবে না। বৌ কথা কও পাখি আর ডাকবে না। কুটুমডাকা পাখি আর ঘরের চালে, সীমের মাচায় আসবে না। মানুষগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো হাজার হাজার বছর ধরে গভীর মমতায় তৈরী করা জীবনের রঙ্গমঞ্চ জ্বলে যেতে, পুড়ে যেতে দেখলো। গোটা দলটা সর্বস্ব হারিয়ে পিতৃপুরুষের ভূমির শ্মশান দৃশ্য দেখতে দেখতে হাঁটে। কেননা স্মৃতির চেয়ে, প্রেমের চেয়ে, দুর্বলতার চেয়ে নগদ প্রাণের দামটা ঢের ঢের বেশী। আপাতত তা হারাতে কেউ রাজি নয়।

বাঁচবার আকাক্সক্ষা সে বিশাল জনস্রোতকে সামনের দিকে ঠেলে দিলো। গোটা বাংলাদেশ রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় হয়ে যেন নিরুদ্দেশ যাত্রা করছে। কাঁদবার ফুরসত নেই। পেছনে তাকাবার অবসর নেই। মরবার শক্তিটুকু খরচ করে বাঁচতে চায়। জীবনের প্রতি মানুষের কি টান! তারা মাইল দুয়েক এসে তিতাসনদীর পাড়ে এসে থামে। তিতাসের পাড়ে অজস্র মানুষের হাট বসেছে। অভুক্ত অশোয়া আতঙ্কতাড়িত দিগি¦দিকজ্ঞানহীন হাজার হাজার মানুষ। কেউ নির্ভার নয়। কারো বাচ্চাকাচ্চা আছে, কেউ বয়সের ভারে কাতর, কেউ কাথাবালিশ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ অনর্থক একরাশ হাড়িকুড়ি নাহক প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এতটা পথ বয়ে এনেছে। সকলেই ওপারের যাত্রী। তিতাস পার হয়ে আখাউড়া যাবে। তারপর বর্ডার পেরিয়ে আগরতলা।

এই প্রাণ হাতে করে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোর চোখে আগরতলা নামটি সঙ্গীতের মতো বাজে, স্বপ্নের মতো আভা ছড়িয়ে দেয়। পা ছড়িয়ে বসা যাবে, নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি দূর করা যাবে। সে আকাক্সিক্ষত স্বর্গে কার আগে কে যাবে তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে। মানুষ অনেক। নাও কেবল দু’খানা। মাঝি দর হেঁকে বসলো মাথাপিছু আট আনা। গুঞ্জন উঠলো মানুষের মধ্য থেকে, ‘এ তো অত্যাচার, মানুষের বাইচ্চা নয়, ডাকাইত।’ কিন্তু মানুষ ঝুপ ঝুপ করে নৌকোয় উঠতে থাকলো লাফিয়ে।

বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। উজানীশরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে। পাঞ্জাবী সৈন্যদের কামানগুলো আরো ঘন আরো জোরে গর্জন করছে। আগুনের শিখা আকাশে দেদীপ্যমান হয়ে উঠছে। ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মানুষের মধ্যে চাপা কিন্তু সতর্কতাসূচক আওয়াজ উঠলো। বইয়া পড়, বইয়া পড়। পেলেন আইতাছে মানুষ দেখলে গুলি ফুট করবে। কুমিল্লার দিক থেকে একটা প্লেন বোঁ বোঁ শব্দ করে অনেক উপর দিয়ে উড়ে আসছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্লেন এখনো দৃষ্টিসীমার মধ্যে ধরা পড়েনি। ‘বইয়া পড়’ শব্দটি মন্ত্রের মতো কাজ করলো! যে যেখানে ছিলো গুটিসুটি মেরে বসে গেলো। ব্রিজের উপরের যারা তারাও বসে গেলো। মাঝি দুজন নৌকো দুখানা ব্রিজের তলায় এসে থামালো। বোঁ করে প্লেনটা অনেক উপর দিয়ে কোণাকুণি উড়ে গেলো। খুব ছোট হয়ে মাটিতে কালোছায়াটা পড়ে উধাও হলো।

সে মেয়েটি তো বসেই ছিলো। প্লেনের শব্দ শুনে ব্রীজের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে গেলো। হাতেপায়ে খিল ধরছে। পাশাপাশি তিনখানা স্লিপারের উপর মেয়েটির শরীর উদরস্থ সন্তানের নিষ্ঠুর অত্যাচারে দুলে দুলে উঠছে। এবার মানুষের দৃষ্টি পড়লো তার উপর। কি ব্যাপার, কি ব্যাপার, এমন করছে কেন। কি মুশকিল! পড়ে যাবে না কি! ওকে কেউ গিয়ে নিয়ে আসো। কে যায়! মেয়েটির পাশ দিয়ে নাকে কাপড় দিয়ে একটি আধবুড়ো মানুষ হেটে এলো। গলায় চাদরটি ঠিকভাবে জড়ানো আছে। ছাতাটিও সঙ্গে করে এনেছে। চেহারা দেখে মনে হয় আদালতের মুন্সি কিংবা মোক্তার কেউ হবে। ডাঙ্গায় নেমে লোকটা দু’দুবার থুতু ফেলে বললো, ‘কি আবার হবে, মাগী ছেলে বিয়াচ্ছে। ছি এই অসময়ে! একটু লাজশরমও নাই।’ কথার টানে মনে হয় স্থানীয় কেউ নয়, অন্য কোথাকার মানুষ।

মানুষের মধ্য থেকে আবার গুঞ্জন উঠলো। আহা প্রাণ! বেদনা উঠেছে। তোমরা কেউ গিয়ে ওকে নিয়ে এসো। জনমতটা গভীর হতে থাকে। আর মেয়েটি শক্ত কঠিন তিনখানা কাঠের স্লিপারের উপর গোঙাচ্ছে। মুখে ফেনা এসে গেছে। পড়ে যেতে পারে, একশো হাত নীচে জল। তোমরা কেউ ওকে নিয়ে এসো। সবাই বসে কিন্তু যায়টা কে! একটা বেঁটেখাটো ফরসাপনা মেয়ে তার স্বামীকে শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বলল, তুমি ঐ বেচারীকে নিয়ে এসো। নইলে তোমার সঙ্গে আমি যাবো না। কথা ক’টি সমবেত সমস্ত মানুষের কাছে আদেশের মত শোনাল। সত্যি সত্যি চারপাঁচজন মানুষ এগিয়ে গেল। অত্যন্ত সন্তর্পণে মেয়েটার পায়ের নীচে, মাথার নীচে, পিঠের নীচে হাত দিয়ে তাকে পাড়ে নিয়ে এল। প্রচণ্ড ভূমিকম্পে পৃথিবীর ভেতরটা যেমন কাঁপে তেমনি কাঁপছে। শরীরের ভেতর শরীর, প্রাণের ভেতর প্রাণ লাফালাফি দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।

সবহারানো মানুষের কয়েকজন দাঁড়িয়ে চুক চুক করে আফশোস করলো। আহারে, মেয়েটি ভারী কষ্ট পাচ্ছে! এমন অসময়! দেখাদেখি আরো মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। একটি মেয়ে বোচকা খুলে দু’খানা পুরোনো শাড়ি বার করে দিল। আর দু’জন মেয়ে মেয়েটাকে যেখানে রেখেছে তার চারদিকে শাড়ির ঘের দিয়ে দিল। একজন বেটাছেলে প্যাকিং বাক্সের ঘর যোগাড় করে এনে দিল। খড়খড়ে শুকনো খড় বিছিয়ে প্রসূতির শয্যারচনা করে তাকে তার উপর শোয়ানো হলো। জীবনের সমস্ত স্থিতি, সমস্ত অবলম্বন ফেলে আসা মানুষগুলো আরেকটি জীবনের নাট্যমঞ্চ তৈরী করার জন্য যত্নবান হয়ে উঠলো। সব ঠিক এখন। একজন দাই পেলে ভালোয় ভালোয় সব হয়ে যায়।

ছবি: রঘু রায়

ছবি: রঘু রায়

রমণীকিঙ্করের মা কোনরকমে ওপাড়ে এসেছে। আকাশের দেবতার উদ্দেশ্যে গালাগাল তখনো থামায়নি। চোখের সামনে কি ঘটছে দেখেও দেখছে না। ভগবান চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে। এতগুলো মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে বের করে এনেছে। রমণীর মা দেখবে কেন! রমণীর মা’র এমন কি দায়! বার বার দাইয়ের কথা শুনে রমণীর মা গোটা ব্যাপারটা আঁচ করে নিল। গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার মুখের অঙ্গনে একটা মমতার ভাব নামলো, ফুটে উঠলো একটা একাগ্রতা। সৃষ্টির কাজে আহবান। সৃষ্টির ডাকে সমস্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা সুমিতি জেগে ওঠে। আকাশের দেবতাকে এ যাত্রা রেহাই দিয়ে ঘেরাটোপের ভেতর চলে এল। কাজে কে না লাগতে চায়! বিদ্যে কে না দেখাতে চায়!

প্রসূতি নিজের বেদনার উত্তাপে সংজ্ঞাহীন। নতুন জীবনের জন্য সব কিছু করছে মেয়েরা। বেটাছেলেরা যারা ছিল বসে নেই। নদী থেকে জল এনে দিচ্ছে। বাঁশ ফেড়ে ফেলে দাঁও দিয়ে কেটে চিকন করে ফালি বানিয়ে দিচ্ছে। নাড়ি কাটতে সুবিধে হবে। ঘেরাটোপের ভেতরে একটা দক্ষযজ্ঞ চলছে। সকলে কান খাড়া করে রেখেছে সেদিকে। মনোযোগ এত একাগ্র যে, পাকিস্তানী সৈন্যের ছত্রিশ পাউন্ডার কামানের গর্জনও শুনতে পাচ্ছে না। সকলে যেন নিজের নিজের হৃদপিণ্ড হাতে নিয়ে বসে আছে। মুহূর্তগুলো সময়ের চালুনির ফাঁক দিয়ে মিহি বালুকণার মত ঝরছে। ইচ্ছে করলে ছুঁয়ে দেখতে পারে। ঘেরাটোপের ভেতরে একটা তীক্ষè চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল। প্রসূতি কঁকিয়ে উঠল। মা মা বলে চীৎকার জুড়ে দিল। ওঁয়া ওঁয়া করে কেঁদে উঠল। সকলে এক সঙ্গে ঘেরাটোপের কাছে এসে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কি অইছে গো, ছেলে না মেয়ে?’ রমণীর মা রক্তের লালবসনে ঢাকা একখণ্ড মাংসপিণ্ড দু’হাতে তুলে নিয়ে দাঁতের মাড়ি দেখিয়ে হাসবার ভঙ্গিতে বলল, ‘ছেলে অইছে গো, ছেলে অইছে’।

ছেলে অইছে গো, ছেলে অইছে। কথাটা দ্রুত খুব দ্রুত আলোড়নের মত ছড়িয়ে পড়লো। মরণভয়ে তাড়িত মানুষেরা আরেকটি নতুন জীবনের আগমন সংবাদ শুনল। যারা হাটছিল গতি বাড়িয়ে দিল। পায়ের চোখ ফুটেছে।

 

প্রথম প্রকাশ: হে স্বদেশ, বাংলাদেশ লেখক শিবির সম্পাদিত (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ফেব্রুয়ারি ১৯৭২), পৃ. ১৩৮-১৪৮

পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ৩৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।