মধুদার স্মৃতি

ভূমিকা: সলিমুল্লাহ খান

 

মহাত্মা আহমদ ছফা এন্তেকাল করিয়াছেন ইংরেজি ২০০১ সালের মধ্যভাগে। তিরোভাবের দশ বছরের মাথায় তদীয় রচনাবলি নয় খণ্ডে বাহির হইয়াছে। তাহার মধ্যে ধরা হয় নাই এমন বহু লেখার দেখা এখনও পাওয়া যাইতেছে। ১৯৯৭ সনে প্রকাশিত ‘মধুদার স্মৃতি’  তাহারই উদাহরণ বিশেষ। ‘মধুদার স্মৃতি’ লেখাটি পাওয়া গিয়াছে ‘মধু দা: শহীদ মধুসূদন দে স্মারক গ্রন্থ’ নামে বাংলা ১৪০৪ ওরফে ইংরেজি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকে। ইহার সম্পাদনা পরিষদ গঠা হইয়াছিল জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ ছয়জন যশস্বী বুদ্ধিজীবীর নাম লইয়া। ইহার প্রকাশক ‘মধু দা স্মৃতি সংসদ’।

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)

‘মধুদার স্মৃতি’ আহমদ ছফার রচনা বলিয়া চিনিয়া লইতে কাহারও কষ্ট হইবার কথা নহে। পহিলা বাক্যেই আহমদ ছফার দস্তখত পরিষ্কার দেখা যায়: ‘কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে সেটাই মুশকিল। মধুদা মানে মধু দা। তাঁর নামের পদবী কি ছিল ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। সত্যি বলতে কি এখনো পর্যন্ত মধুদার পদবীটি আমার জানা হয়নি।’ এই একটি বাক্যের মধ্যেই আহমদ ছফা গণতন্ত্রের একটি ভূমিকা লিখিয়া বসিয়াছেন। পদবীতে কিবা আসে কিবা যায়!

পদবীর পরপরই আসে গায়ের রঙ্গ আর মুখের জবান। মধুদার গায়ের রঙ্গ ধবধবে শাদা হইলেও দেখাইত একটু তামাটে। মহাদেবের মত চেহারা হইলেও তাঁহার মুখের জবান ছিল আদি এবং অকৃত্রিম ঢাকাইয়া। মানুষের মুখের বাক্যটাই শেষ বাক্য নহে। মানুষের ভাষার মধ্যে ভঙ্গী বলিয়াও একটি বাক্য আছে। আহমদ ছফা তাহা হইতেই মধুদা ওরফে শহীদ মধুসূদন দের চেহারা আঁকিয়াছেন। কিন্তু মধুর আসল মধু অন্য জায়গায়। ১৯৬০ সালের দশক কি তাহার পরের দশক জুড়িয়া ছাত্রছাত্রীদের জীবন ছিল বাকিতে খাওয়ার জীবন। মধুদা ছাত্রছাত্রীদের উপর বিশ্বাস হারান নাই। তিনি বাকিতে খাওয়াইতেন। আর ছাত্রছাত্রীরাও শেষ পর্যন্ত তাঁহার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেন নাই। মানুষের জীবনের ছবি মাত্র এমন একটি কি দুইটি সরলরেখায় আঁকিতে পারেন আহমদ ছফা। বাংলা লেখার জগতে তাঁহার জুড়ি বেশি পাওয়া ভার। তাঁহার লেখা বাংলা মদের মতন। স্বাদে ও গন্ধে তীব্র। স্বদেশী।

ছাত্রছাত্রীদের জীবন দারিদ্রের জীবন। এই জীবনে বাকিতে খাওয়ায় একটা তাৎপর্য আছে। আহমদ ছফা বিশেষ বলিতে যে দশকের কথা লিখিয়াছেন তাহা ১৯৬০ সালের পরের দশক। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন তখন বেগবান হইতেছিল। একেকটা সময় আসে যখন সময়ের গুণে একেকটা মানুষের ভেতরের গুণ বাহিরে দশগুণ বড় হইয়া জাহির হয়। শহীদ মধুদার জীবনে সেই বড়গুণটা আহমদ ছফা দেখিতে পাইয়াছিলেন। নিজে চিনি-ময়দা রেশন উঠাইতে না পারিলেও ছাত্রছাত্রীদের বাকিতে খাওয়ানো কদাচ বন্ধ করেন নাই মধুদা। আহমদ ছফা এই ‘বোকামি’র মধ্যে মধুদার বড়ত্ব দেখিতে পাইয়াছিলেন। যিনি নিজে বড় নহেন, তিনি মানুষের মধ্যে বড়ত্ব কদাচ দেখিতে পাইবেন না। আহমদ ছফাও বড় মানুষ। তাই তিনি মধুদার বড়ত্ব দেখিয়াছেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘাতকরা যাঁহাকে রেহাই দেয় নাই — ইতিহাস তাঁহাকে রেহাই দিয়াছে। আহমদ ছফার দুই পাতায় তাঁহার মহত্বের অক্ষয় কাহিনী মহাকাল স্বয়ং লিখিয়াছেন।

একটা জায়গায় আহমদ ছফার খুব সম্ভব একটা স্মৃতিবিভ্রম হইয়াছে। মহৎ মানুষেরও কখনও কখনও স্মৃতির বিভ্রম হয়। আহমদ ছফা এক জায়গায় লিখিয়াছেন, ‘একজনের কথা আমার মনে আছে। তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। তিনি কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন। ফরেন সার্ভিসে আড়াই কি তিন বছর কাজ করার পর — আমি তাঁকে দেখেছি — দোকানে এসে মধুদার বাকি পাওনা পরিশোধ করতে।’ এখন মানে ১৯৯৭ সালে যিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন — তিনি নিজেই আমাকে বলিয়াছেন — তিনি আহমদ ছফার শিক্ষক ছিলেন না — ছিলেন শিষ্যস্থানীয় বা বন্ধুতুল্য অনুজ। বিভ্রমের একটা সম্ভাব্য কারণ এই যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে একই নামের অপর একজন সিনিয়র কূটনীতিক ছিলেন। তিনি সম্প্রতি প্রয়াত হইয়াছেন। তিনি ১৯৬০ দশকের গোড়ায় চট্টগ্রাম জেলার অন্তঃপাতী নাজিরহাট কলেজে শিক্ষক ছিলেন। আহমদ ছফা ছিলেন সেই কলেজের ছাত্র।

ফ্রিডরিখ নিৎসে একদা গুজব রটাইয়াছিলেন ঈশ্বর এন্তেকাল করিয়াছেন। প্রকৃত ঘটনা তাহা নহে। ঈশ্বরের এন্তেকালসংবাদ খানিক অতিরঞ্জিত। জাক লাকাঁর ফতোয়া মোতাবেক বলিতে হইবে ঈশ্বর এন্তেকাল করেন নাই, ঈশ্বর অজ্ঞান হইয়াছেন মাত্র। আমাদের বর্তমান নামবিভ্রাটেও হয়তো তাঁহারই খবর মিলিতেছে।

 

 

কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে সেটাই মুশকিল। মধুদা মানে মধু দা। তাঁর নামের পদবী কি ছিল ও নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। সত্যি বলতে কি এখনো পর্যন্ত মধুদার পদবীটি আমার জানা হয়নি।

মধুদার নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে লম্বাচওড়া শালপ্রাংশু একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। মহাদেবের মতো চেহারা ছিল মধুদার। গায়ের রঙ একেবারে ধবধবে শাদা। তিনি রোদে রোদে ঘোরাফেরা করতেন বলে দেখাত একটু তামাটে।

শহীদ মধুসূদন দে’র প্রতিকৃতি

শহীদ মধুসূদন দে’র প্রতিকৃতি

মধুদা আদি এবং অকৃত্রিম ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গীটির মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যেটা একেবারে আমাদের মরমে গিয়ে পশতো। তাঁর সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনে বেশি কথাবার্তা হয়নি। যাও হয়েছে ঐ বাকি খাওয়া নিয়ে। সারাদিন পাঁচজন মিলে বিশ কাপ চা, দশটা সিঙ্গারা খেয়েছি। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসার সময় বলতাম, মধুদা লিখে রাখেন বিশ কাপ চা, দশটা সিঙ্গারা। শুনে তিনি গজর গজর করতেন: কেবল তো কইয়া যাইতেছেন, এই পর্যন্ত কত অইছে হিসাব রাখছেননি? মধুদা খাতা খুলে হিসাব দেখাতে চাইতেন। আমরা বলতাম, থাক থাক, মধুদা, হিসাব দেখাতে হবে না, সব শোধ করে দেব। আমরা জানতাম মধুদার বাকির খাতায় নাম থাকলেও সকলের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব থাকত না। শুধু ভয় দেখাবার জন্য খাতা খোলার ভঙ্গীটি করতেন। মধুদার সবচাইতে বড় গুণ ছিল তিনি ছাত্রছাত্রীদের অসম্ভব বিশ্বাস করতেন। আমি এমন অনেকের কথা জানি যাদের মধ্যে একজনের বাকির পরিমাণ অনেক, ধরুন একশ টাকা। পঞ্চাশ টাকা মধুদার হাতে দিয়ে বলত, এই আছে। আর দিতে পারব না। তিনি বলতেন, অইছে অইছে, যান।

মধুদা ক্যান্টিনে সকালের দিকে বসতেন না। বাইরে নানা কাজে ঘোরাঘুরি করতেন। দুপুরে সময় পেলে একবার এসে ক্যাশে বসতেন। সময় না পেলে আসতেন একেবারে চারটের পর। এসেই কর্মচারীদের জিগ্যেস করতেন, আইজকা মোয়াজ্জেম সাব আইছিল? তাঁর লোকেরা বলত, হ। তিনি বললেন, লেখো বিশ কাপ চা। জাফর সাব? হ। লেখো বিশ কাপ। এমনি করে যে সমস্ত ছাত্রনেতা মধুর ক্যান্টিনে বসে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতেন, তারা কে কয় কাপ চা খেতেন, মধুদা বলবেন কি তারা নিজেরাও বলতে পারতেন না। অতএব মধুদা অনুমান করে এক একটা সংখ্যা বসিয়ে দিতেন। যেমন মোয়াজ্জেম সাব বিশ কাপ, ফরমান উল্লাহ পনেরো কাপ। চায়ের কাপের অঙ্কটা তো মধুদা বসাতেন। টাকাটা আদায় হত কি না আমার সন্দেহ।

অনেককেই বলতে শুনেছি ডাকসাইটে ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে মধুদা কোন বিল দাবি করতেন না। কেউ জীবনে কেউকেটা হয়ে তাঁর সামনে এসে একদিন দাঁড়ালে তিনি খাতাটা নিয়ে হাজির হতেন। বলতেন, অহন তো খুব বড় ছাব অইছেন, বিল কত বাকি আছে জানেন! পাঁচশ টাকা বাকি থাকলে মধুদা নাকি পাঁচগুণ বাড়িয়ে বলে গলায় গামছা দিয়ে আদায় করতেন। এই সংবাদ লোকমুখে শুনে শুনে আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। কিন্তু একটি ঘটনায় আমার টনক নড়ে।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছি। থাকতাম পুরানা পল্টনের দিকে একটা মেসে। একদিন দেখি মধুদা রাস্তা দিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন। এমনিতে তিনি ধুতিটা শক্ত করে পরতেন এবং সবসময় বকের পাখনার মতো শাদা রাখতে চেষ্টা করতেন। আজ দেখলাম তাঁর ধুতিটা মলিন, জামাটাও। মোটা মানুষ। বোধ হয় দীর্ঘপথ হেঁটে এসেছেন। শরীর দিয়ে দরদর ঘাম ছুটছে। আমি জিগ্যেস করলাম, মধুদা, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? তিনি বললেন, আরে! আমি মনে মনে আপনারেই খোঁজ করতাছি। আমি একটুখানি অবাক হয়ে গেলাম। মধুদা আমার মত হেঁজিপেঁজি মানুষকে খুঁজবেন কেন? তাঁর তো বড় মানুষদের নিয়ে কারবার। আমি বললাম, মধুদা বলুন, কেন আমাকে খুঁজছেন। তিনি বললেন, আপনে কই থাকেন? আমি বললাম, এই কাছেই। একটা মেসে। তিনি বললেন, লন আপনার ঘরে যাই। আমার ঘরে ঢুকেই মধুদা বললেন, আপনি আমারে একশটা টাকা দিবেন। আমি চিনি-ময়দা রেশন উঠাইবার পারি নাই। তারপর মধুদা তাঁর গল্পটা বললেন। আজকে সকাল থেকে তিনজনের অফিসে গিয়েছেন যাদের কাছে মধুদা টাকা পাবেন। কেউ তাঁকে এক আধলাও দেয়নি।

সকলে যে মধুদার টাকা মেরে দিতেন, এটা সত্যি নয়। কাউকে কাউকে আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসেও মধুদার টাকা শোধ করতে দেখেছি। একজনের কথা আমার মনে আছে। তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির। তিনি কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন। ফরেন সার্ভিসে আড়াই কি তিন বছর কাজ করার পর – আমি তাঁকে দেখেছি – দোকানে এসে মধুদার বাকি পাওনা পরিশোধ করতে।

এ কথাও সত্য যে, অনেকেই মধুদার টাকা দেয়নি। কিন্তু মধুদা কারো নামে মুখ ফুটে নালিশ করেননি। আমার তো মনে হয় না মধুদার সব ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতেন পারব। টাকার কথাটা আমি বলব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সচ্ছল জীবন কাটেনি। মধুদা কেমন করে যেন বুঝতে পারতেন আমার হাতে টাকা নেই। দোকানে বাকিতে খেয়ে যেতাম। মধুদার এই দেখেও না দেখার ভান করার ব্যাপারটিকে অনেকেই বলবেন বোকামি। আমি বলব বড়ত্ব। আসলে মধুদা একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

 

প্রথম প্রকাশ: মধু দা: শহীদ মধুসূদন দে স্মারক গ্রন্থ, ১ বৈশাখ ১৪০৪

পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন , নবপর্যায় ৩৫, ৫ জানুয়ারি ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।