শুধু একটি শব্দের জন্য

তুমি যখন রজনীগন্ধার ডাঁটার মত নত হয়ে
ঘরের মধ্যে পা রাখলে সারাঘরে খেলে গেল একটা স্পন্দন
হঠাৎ যেন বদ্ধ হওয়া শিউরে উঠল।
তুমি যখন বাঁকাচোরা হাত দুটো আলতোভাবে
কোলের উপর শুইয়ে রাখলে
অপার বাঙময় সে দুটো অপরূপ হাত
বীণার মত বেজে উঠতে চাইল।
তুমি যখন শরীরের বসন টেনে টুনে ঠিক করায়
হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে উঠলে, মনে হল
শরীর ঢাকতে গিয়ে তুমি শরীর থেকে পালাতে চাইছ।

অমনি তোমার ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ
বিদ্যুৎপ্রবাহ নির্গত হয়ে আমাকে তড়িতাহত করল।
তুমি যখন কার্পেটে বুড়ো আঙুল খুঁটে খুঁটে মেঝের
পানে তাকিয়ে খুউব নিচুস্বরে কথা বললে
মনে হয় ঘরে দেয়ালগুলো সন্তর্পণে কান পেতে আছে
যাতে তোমার প্রতিটি উচ্চারিত ধ্বনি দেয়ালের মর্মে বিধে থাকে।

যখন আমি তোমার কাছে গেলাম, মনে হল
একটা ন¤্র নির্জন ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
জাগতিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে যার উৎসস্থল।
আর যে ঝর্ণা মৃদুস্বরে কেবল নিজের সঙ্গেই আলাপ করে।
আমি যখন তোমার ঘরের বাইরে পা রাখলাম
আমার রক্তে, আমার অনুভবে ফুটন্ত ঝর্ণার আবেগ;
একটা মৃদু মোহন প্রীতিবদ উত্তাপে আমার
ভেতরের পদার্থ সকল গলানো মোমের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যত দূরেই যাচ্ছি পথের পাশের সব কিছুর মধ্যে
যে ঝর্ণার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি,
সে অদৃশ্য ঝর্ণার ঝংকার শুনতে পাচ্ছি।

আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।

তুমি আমাকে চরাচরে প্রবাহিত হওয়ার
আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী করেছ।
তুমি আমার হাতে তুলে দিলে বিশ্বলোকে
বিহার করার টাটকা নতুন ছাড়পত্র।
হে নারী তোমাকে কি নামে ডাকব।
কোন নামে ডাকলে তোমার হৃৎকমল সুখসমীরে
আন্দোলিত হয়। কোন নামে ডাকলে আমার
নাভিপদ্মের মূল থেকে শৈলের
সোনালী পোনার মত যে অনুভবরাশি
ওপরে ভেসে উঠেছে তার বিশ্বস্ত প্রকাশ ঘটাতে পারি!

 

নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, আহমদ ছফা রচনাবলী, ৩য় খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।