ক্যাম্পাস স্মৃতি

সুধীর চক্রবর্তী: বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এখন কেমন লিখছে বলে আপনার মনে হয়?

আহমদ ছফা: বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এখন খারাপ লিখছে এটা বলব না, ভাল লিখছে এটাও বলব না। এখন একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। আগে আমরা যখন লেখালেখি করেছি, সামনে একটা মড়ধষ ছিল আমরা দেশকে স্বাধীন করব, তারও পরে দেশটাকে তৈরী করব। এখন তরুণদের সামনে কোন স্বপ্ন নেই।

সুধীর চক্রবর্তী: দুই বাংলার মিলমিশের ব্যাপারটা; সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে আপনার মতামতটা কি?

আহমদ ছফা: আমি পরবর্তী প্রজন্মের কথা বলছি। আমাদের কথা না। আমি যখন ’৭১-এ কলকাতায় তখন  ওখানকার সাহিত্যিকদেরকে চিনতাম। সমরেশ বসু, অন্নদাশঙ্কর রায় রাজনৈতিকভাবে ভাঙ্গা গড়ার ব্যাপারটায় আমরা কিছু করতে পারব না, অন্ততঃপক্ষে একটা অল বেঙ্গল কালচারাল অর্গানাইজেশন দাঁড় করানো সেই সময় ছিল আমার একটা স্বপ্ন। আমি মনে করি বাঙ্গালিরা এক এবং…

সুধীর চক্রবর্তী: অবিভাজ্য।

আহমদ ছফা: এই শতাব্দীতে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাঙালির একটা নিজস্ব জাতীয় রাষ্ট্র এবং পশ্চিম বাংলা তার বাইরে নয়। পূর্বাঞ্চলে… একটা রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, সেটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন হবে এবং…

সুধীর চক্রবর্তী: দুই বাংলা মিলেও যেতে পারে।

আহমদ ছফা: আমার তাই বিশ্বাস। আসামও হয়তো…। যেমন ধরুন ভারতের ইতিহাসে কতগুলো ঘটনা ঘটেছে, যখন শংকরাচার্য খুব বৌদ্ধদের নিধন করল, অশোক যখন খুব বৌদ্ধ ধর্মের উপর চাপ দিল তখন দেখা গেল যে হিন্দুরা এর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। আবার দেখা যায় ওরা যখন নিজেরা হিন্দু ধর্মের উপর চাপ দিল — তখন সেই ফাঁক দিয়ে মুসলমানরা এই দেশে এসে পড়ল। আবার আওরঙ্গজেব যখন মুসলমান ধর্ম নিয়ে খুব চাপাচাপি শুরু করল তখন মোগল সা¤্রাজ্যের পতন হল। এখন উত্তর ভারতে যে রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সেটা ভারতকে একত্র, একসাথে রাখতে নাও পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদের দায়িত্ব হবে…

সুধীর চক্রবর্তী: পূর্বাঞ্চলকে এক করে ফেলা। আচ্ছা আরেকটা কথা, বিভাগপূর্বে আমরা দেখেছি মুসলমান লেখকদের তেমন দেখা যায় না, কিন্তু যেই দেশ ভাগ হয়ে গেল তখন আমরা দেখলাম শিক্ষায়, সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানরা এগিয়ে গেল। এটাকে আমি বলব সংখ্যাগরিষ্ঠের একটা পাওনা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অবস্থানটা কী? তারা তো মাইনরিটি।

আহমদ ছফা: সেটা আমি বলব যেমন ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ বাঙালি মুসলমান লেখক বেরিয়েছে ’৫০ থেকে ’৬০ এই দশ বছরে তার পঞ্চাশগুণ বেশি বেরিয়েছে। এদের গুণগত মান সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। এটা সামাজিক প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে, এতে সময়ের অস্থিরতাটা আছে… এখন পর্যন্ত সে রকম আর পাচ্ছি না — আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিছুটা করেছে। আমার একটা বই আছে এ সম্পর্কে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। মনের যে সম্পূর্ণ প্রসারতা, অনাবিলতা সেটা এখন পর্যন্ত হয় নি। হবে না তা নয়, কিন্তু এখনও তো দেখছি না। আগে  যখন ভারতে বাঙলা এক ছিল তখন ধরুন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন শহীদুল্লাহ্, মুজতবা আলী, কাজী আব্দুল ওদুদ, তারপর আরো অনেকে। যখন দেশ ভাগ হল, মুসলমানরা তো তখন মাইনরিটি। এখন যারা লিখছে তারা তো হাতে গোনা — সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, আবুল বাশার, করিম খান, একরাম আলী। মুসলমানদের মধ্যে যে নমঃশুদ্র তাদের সংখ্যা ৪ কোটি। তাদের কথা কোথায়? আমি অবাক হই, এরা যদি না থাকে তাহলে কি করে হবে?

সুধীর চক্রবর্তী: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছু বলবেন?

আহমদ ছফা: বাংলার শাসনকেন্দ্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ছিল। আর বাঙালির মূল স্রোতে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারা এসে মিলিত হয়েছে, কখনও নাথদের ধারা, কখনও শাক্তদের ধারা, কখনও বৌদ্ধদের ধারা, সনাতনপন্থীদের ধারা, পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক ধারা — এখন এমন একটা সময় এসেছে, জাতীয়তাবাদ বলতে যে জিনিসটা বুঝাতে চাচ্ছি — এ প্রশ্নটার আমি সরাসরি ভিতরে যাব না কারণ সেটার প্রয়োজন পড়ে না, আমি যেটা করব সেটা হচ্ছে এই — এ সমস্ত ধারাগুলো নিয়ে একটা মহান ধারা তৈরি হতে পারে — অনেকগুলো উপনদী-শাখানদী মিলিত হয়ে একটা বড় নদী তৈরি হতে পারে। এখন আমাদের সময় এসেছে একটা বড় ধারা তৈরি করার। বড় ধারাটা তৈরি করলে এটাই জাতীয়তাবাদ তৈরি করবে।

8

সুধীর চক্রবর্তী: সেটা কি আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে যাবে?

আহমদ ছফা: কথায় কথায় আন্তর্জাতিকতাকে আনা — এগুলো খুব যান্ত্রিক একটা প্রকাশ — স্লোগানের মত শোনায় অর্থাৎ যদিও আমরা পৃথিবীর বাইরে না, আমরা যদি আমাদের লোকগুলোকে থাকার মত একটা অবস্থা তৈরী করতে পারি, আন্তর্জাতিকতাবাদকে সেখানে অবশ্যই রাখতে হবে। আর যদি আন্তর্জাতিকতাবাদের নামে লাফাতে থাকি — স্লোগানটাই হবে, আসলে আন্তর্জাতিকতাবাদের কিছু থাকবে না। এখন আমার প্রশ্ন হতে পারে অতীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ উঠতে পারে নাই; উঠতে না পারার অনেকগুলো কারণ ছিল — বলছি। বাঙালি হচ্ছে খুব হতভাগ্য জাতি। সে দিয়েছে অনেক কিন্তু পেয়েছে খুব কম এবং প্রথম থেকে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের একটা ষড়যন্ত্র ছিল। সে প্রথমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তৈরী করল — বাংলাতে প্রথম শিপিং, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স এই সমস্ত চালু হল। তখন ব্রিটিশরা দেখল যে যদি এরা এত তাড়াতাড়ি আগায় তাহলে এরা কম্পিটিশানে জিতে যাবে — তো ব্রিটিশরা এসব এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল দুটা কারণে। এক, শাসনতন্ত্রকে নিশ্চিত ও নিরাপদ রাখা, দুই ব্রিটিশ বেনিয়াদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকতে দেওয়া, এ জন্য এখানকার ব্যবসায়ী এই যে রামদুলাল সরকার, দ্বারকানাথ ঠাকুর এদেরকে জমিদার বানিয়ে দেওয়া হল — অলস জমিদার, বুঝেছেন এতে একদিকে শাসনতন্ত্র মজবুত হল, অন্যদিকে ব্যবসায়ে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। যেমন ধরুণ অশোক মিত্র তো সিপিএমের ইকোনমিস্ট, অশোক মিত্রদের কথা হল বঙ্গভঙ্গটা ছিল আত্মহত্যা — কারণ তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত তৈরী হচ্ছিল আর বাঙালি মধ্যবিত্ত তৈরী হয়ে পড়লে শক্ত একটা ভিত হত, দ্বিতীয়ত যে জিনিসটা তা হচ্ছে ঐ যে সি আর দাশের বেঙ্গল প্যাক্ট — এটা স্থায়ী হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী ভিত তৈরী করত — আর বাংলা না ভাঙ্গলে হয়ত ভারতও ভাগ হত না। এটা অশোক মিত্রের কথা। আরেকটা জিনিস — দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বাংলার অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে দেওয়া হল — বাংলার অর্থনীতি নষ্ট হয়ে গেল — তারপর যা কিছু তৈরী হতে লাগল অবাঙ্গালিদের পয়সায়…

সুধীর চক্রবর্তী: তারপর জাতীয় নেতৃত্ব থেকেও বাঙ্গালিরা সরে গেল।

আহমদ ছফা: আমি সে সময়, ’৭১-এ যখন কলকাতায় গেলাম, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আমি তখনকার পত্রপত্রিকা খুঁজলাম সুভাস বসু যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন পত্রিকাগুলো কি লিখছে… তা আমার খোঁজাখুঁজিতে যা পেলাম, বাঙালিদের পয়সা ছিল না রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর — সুভাস বসু যে দেশ থেকে চলে গেল তার কারণ হচ্ছে পাঞ্জাবিরা, মাড়োয়ারিরা তাকে পয়সা দেয়নি আন্দোলন চালানোর জন্য, এ-জন্য তাকে  দেশ ছেড়ে চলে যেতে হল। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়ল।

অনুলিখন: ইউসুফ রেজা

উৎস: ‘পরবাস’, ৩য় বর্ষ ২য় সংখ্যা, শরৎ ১৪০৬
পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ১৯, ৩১ জুলাই  ২০১৩

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।