ড. ড্যানিয়েল ডানহাম এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রাম

এই রচনাটি আমি নিউইয়র্কের প্রয়াত ড. ড্যানিয়েল ডানহামের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যেই লিখছি। ড. ড্যানিয়েল ডানহামের বেগম আমাকে কিছুদিন পূর্বে একটা চিঠিতে জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী আটাত্তর বছর বয়সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মেরী ফ্রান্সিস আমাকে কম্পিউটার করা চিঠির মার্জিনে তাঁর সুন্দর গোটা গোটা হস্তাক্ষরে ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘যে মানুষ জাহাজের সামান্য কর্মচারী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলো, যে মানুষ হাসপাতালে সেবকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলো, যে মানুষ কঠিন সংগ্রাম করে একজন সেরা স্থপতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো, দেশে-বিদেশে তার রেখে যাওয়া অনেক স্থাপত্যকীর্তি, পুরস্কার পাওয়া নাটক, নানা প্রতিষ্ঠানের দেয়া পদক, অসংখ্য প্রবন্ধ, লিখিত বক্তৃতা এবং সুপ্রচুর গবেষণা, সব ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেছে।’

এই রচনায় আমি বেগম মেরী ফ্রান্সিস ডানহাম সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা বলবো। তার আগে ড. ড্যানিয়েল ডানহাম কে ছিলেন সে সম্পর্কে পাঠক-পাঠিকাদের জানাতে চাই। ড. ড্যানিয়েল ডানহাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সস্ত্রীক এসেছিলেন ষাটের দশকের প্রথম দিকে। তখন সবে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়েছে। ড. ডানহাম এসেছিলেন পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে। ঢাকা এসেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগটির ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে এই বিভাগের ডীন এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম দিকে যে সমস্ত তরুণ স্থপতি হিসেবে পাস করে বেরিয়ে এসেছিলেন তারা সকলে ছিলেন ড. ড্যানিয়েল ডানহামের ছাত্র। বলতে গেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের স্থাপত্য বিদ্যায় হাতে খড়ি ড. ডানহামের হাতেই হয়েছে। ড. ডানহাম ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ এবং অত্যন্ত সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। স্থাপত্যবিদ্যায় যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটির প্রধান নকশাকার। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেটা গ্রন্থাগার, তার নকশাও তিনি তৈরি করেছিলেন। এছাড়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্থপতি ছিলেন তিনি। আরো অনেক ছোটখাট ইমারত নির্মাণে তিনি সহায়তা করেছেন। ভারতেও তাঁর কিছু স্থাপত্যকীর্তি ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। বাংলাদেশের সংসদ ভবনের স্থপতি লুই কান ছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু।

১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আমি মেরীর নিমন্ত্রণে আরো তিনজন বাংলাদেশীসহ ড. ডানহামদের ম্যানহাটনের এপার্টমেন্ট-এ গিয়েছিলাম। সেদিন মেরী এবং ডানহাম আমাদের জন্যে বাংলাদেশী খাবার ভাত-মাছ-মাংস-সবজি এবং ডাল রান্না করেছিলেন। খেতে খেতে অনেক গল্প করেছিলাম। তিনি আমাদের কাছে স্থপতি লুই কান কীরকম শোচনীয়ভাবে মারা গিয়েছিলেন, সে কাহিনীটি বয়ান করেছিলেন। লুই কান প্লেনে নিউইয়র্কে আসছিলেন এবং প্লেনেই স্ট্রোক করে মারা যান। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ তাঁর মৃতদেহ নিয়ে একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। তারা লুই কানের বাড়ির ঠিকানা জানতো না। তাঁর পকেট অনুসন্ধান করে যে বিজনেস কার্ড পাওয়া গেল তাতে তাঁর অফিসের ঠিকানাটা ছিল। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানা সম্ভব হলো না। আর সেদিন বন্ধ। অগত্যা এয়ারপোর্টের লোকেরা তাঁর মৃতদেহ মর্গে রেখে দিতে বাধ্য হয়। পরে সোমবারে অফিস খুললে সেখান থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে লুই কানের পরিবারকে খবর দেয়া হয়। মর্গ থেকে তারা মৃতদেহ সংগ্রহ করে সৎকারের ব্যবস্থা করেন।

ড. ড্যানিয়েলরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের একটি অভিজাত এলাকায় থাকেন। একটি  অভিজাত এলাকায় তাদের ফ্ল্যাট বাড়িটি ছিল বেশ বড়ো। বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা একটি বাংলাদেশী পরিবারকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান। খুব সম্ভবত এ পরিবারটিও তাদের ধারে কাছে কোথাও বাস করতো। সময়ে অসময়ে প্রয়োজন হলে তাদের সহায়তা করতেন। মেরী ফ্রান্সিস এবং ড. ডানহামের এই বাড়িটি বাংলাদেশের মানুষের জন্যে আরো একটা বিশেষ কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকার কথা।

১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়,  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমেরিকার জনমত গড়ে তোলার কাজে মেরী এবং ডানহাম সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যের নৃসংশতা এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার কাজে তাদের বাড়িটি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশী তরুণেরা দলে দলে তাদের বাড়িতে এসে সমবেত হতেন এবং কিভাবে জনমত সৃষ্টি করা যায় সে বিষয়ে নানারকম পন্থা উদ্ভাবন করার জন্যে সর্বক্ষণ চেষ্টিতে থাকতেন। এই সমস্ত তরুণকে মেরী এবং ড. ডানহাম নিজ হাতে রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন।

মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন করার জন্যে নানা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলে দিয়েছেন। এই পরিবারটির কাছে আমাদের বাংলাদেশীদের অনেক ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশের এমন অকৃত্রিম বন্ধু আমেরিকায় আর আছে কি-না আমি জানি না।

ড. ড্যানিয়েল ডানহাম যখন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন, তাঁর স্ত্রী মেরী এই অঞ্চলের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি সবিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক ড. আহমদ শরীফকে তাঁর বাংলা ভাষা শেখানোর শিক্ষক হিসেবে বেছে নেন। ২০০০ সালে ড. আহমদ শরীফের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ভীষণ ব্যথিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনের বেদনা প্রকাশ করে আমাকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেন। সেই চিঠিতে ড. আহমদ শরীফের জ্ঞান-গরিমা, ঋজু ব্যক্তিত্ব এবং উন্নত চরিত্র সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন।

ড. ডানহাম এবং তাঁর স্ত্রী মেরী ফ্রান্সিস এই দেশে অনেক দিন বসবাস করে গেছেন। ড. ডানহাম কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। মেরী তাঁর বাড়তি সময়টুকু বাংলাদেশী সংস্কৃতির নানা প্রণিধানযোগ্য দিকগুলো সম্বন্ধে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করে যেতেন। তিনি কবি জসিম উদ্দীনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। কবির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পূর্বে তাঁর রচিত ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ এবং ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ এই মহান কাব্যগ্রন্থ দু’টোর ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেন। কাব্য গ্রন্থ দু’টোর সারল্য এবং সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলন মেরী। মিসেস মেরী ফ্রান্সিস ছিলেন অত্যন্ত বিদূষী মহিলা। গ্রীক ছিল তাঁর মাতৃভাষা। তিনি মূল গ্রীকে ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’ গ্রন্থ দু’টো পাঠ করেছেন। তিনি ফ্রান্সের সরোবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন। তারপর সঙ্গীত শাস্ত্রে বুৎপত্তিসম্পন্ন একজন গবেষক হিসেবে আমেরিকান পণ্ডিত সমাজে তাঁর খ্যাতি এবং পরিচিতি দুই রয়েছে।

মূলত কবি জসীম উদ্দীনই তাঁকে বাংলার লোকসাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন। ডানহাম পরিবার যতোদিন বাংলাদেশে ছিলেন মেরী নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে লোকসাহিত্যের গতি প্রকৃতি সম্বন্ধে সবিশেষ জ্ঞান লাভ করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কারণ দু’বছর আগে ঢাকাস্থ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে তাঁর সুবৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ ‘জারিগান অব বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থটি রচনার কাজে মেরী অন্যূন বিশ বছরের অধিক সময় ব্যয় করেছেন। মেরীর পূর্বে কোনো পশ্চিমা পণ্ডিত বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে কোনো গ্রন্থাদি প্রকাশ করেননি। মেরী বাঙালি মুসলমান সমাজকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ধরে নিয়ে তার যে কতকগুলো আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাঁর গ্রন্থটিতে [তা] তুলে ধরেছেন।

আমার সঙ্গে মেরীর পরিচয় ১৯৯৫ সালে। লেনিন নামে একজন তরুণ মেরীর গবেষণা সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। একদিন লেনিন আমাকে এসে জানালেন একজন আমেরিকান মহিলা বাংলাদেশের জারিগানের ওপর একটি বই লিখেছেন, তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দেখাতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললাম, লোকসাহিত্য সম্পর্কে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই। লেনিন আমাকে বললেন, আপনি তো জারিগান লিখে থাকেন। আমাকে একবার ঠেকায় পড়ে একটি জারিগান লেখার কসরত করতে হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে একটি গানের দল জার্মানিতে যাচ্ছিলো। তারা স্থির করেছিল বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরে একটি জারিগান পরিবেশন করবে। হাতের কাছে সে রকম গান লেখার কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে বাধ্য হয়ে আমাকে একটা জারিগান লিখতে হয়েছিল। আমি বল্লাম ঠিক আছে নিয়ে আসেন।

সপ্তাখানেক বাদে আমার চিলেকাঠায় এলেন মেরী। একহারা কৃশ মহিলা। ষাটের ওপরে বয়স। শরীরের বাঁধুনি খুব শক্ত। তিনি একটা ইংরেজি পাণ্ডুলিপি আমাকে দিয়ে বললেন, আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমার পাণ্ডুলিপিটা পাঠ করে কোথায় কোথায় পরিবর্তন করতে হবে দেখিয়ে দেন, আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি বললাম, আমি দু’দিক দিয়েই মূর্খ মানুষ। প্রথমত লোকসাহিত্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান সামান্য এবং আবার ইংরেজি ভাষার দখল অত্যন্ত অল্প। মেরী বললেন, তথাপি আমি অনুরোধ করবো আপনি পাণ্ডুলিপিটা দেখুন। অগত্যা পাণ্ডুলিপিটা আমাকে গ্রহণ করতে হলো। এক সপ্তাহ বাদে মেরী যখন দ্বিতীয়বার আসেন, আমার সামান্য জ্ঞানে যা মনে হয়েছে, চার-পাঁচটি জায়গা দেখিয়ে বললাম, এই সব বিষয়ে যদি আপনি পুনর্বিবেচনা করেন তাহলে লেখাটি সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়। মেরী বললেন, ঠিক আছে। আজ থেকে এক বছর পর আবার আপনার সঙ্গে সংশোধিত পাণ্ডুলিপি নিয়েই দেখা করবো।

১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত চলছিলো, সে সময়টিতে মানসিকভাবে আমি অত্যন্ত উতলা হয়ে পড়েছিলাম। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ক্ষমাচ্যুত করার জন্যে যেভাবে অনবরত হরতাল ইত্যাদি করে যাচ্ছিলো, সেগুলোর সঙ্গে আমি মন মেলাতে পারছিলাম না। অন্যদিকে বিএনপিকে সমর্থন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানসিক অবস্থাতেই আমি একটি উপন্যাস লেখার কাজে হাত দেই এবং ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসটি লিখে ফেলি। অল্পদিনের মধ্যেই লেখাটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছিলো। আমি ছিলাম মানসিকভাবে প্রচণ্ড রকম অশান্ত। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে উপন্যাসটি ইংরেজি করা যায় কিনা চেষ্টা করছিলাম। প্রিসিলা নামের একটি স্নেহভাজন মেয়ে আমাকে সাহায্য করতে রাজি হলো। আমি মূলত বই দেখে ইংরেজিটা বলে যেতাম, প্রিসিলা লিখে নিতো। এইভাবে অনুবাদ কাজটি শেষ করে ফেলি। অনুবাদ তো করলাম কিন্তু সেটা সাপ-ব্যাঙ কী হয়েছে বলে দেয়ার তো কোন লোক নেই। আমি মনে মনে কামনা করছিলাম, এমন একজন লোককে যদি পাওয়া যায় যার মাতৃভাষা ইংরেজি এবং সাহিত্য সম্পর্কে গভীর ধারণা আছে। সেই সময়টি মেরী তার সংশোধিত পাণ্ডুলিপিটাসহ এক সকাল বেলা একটি ভাঙাচোরা লেডিস সাইকেলে চড়ে আমার বাড়িতে হাজির হলেন এবং টেনে টেনে সাইকেলটাও চারতলায় তুলে নিয়ে এলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম মহিলাটি দেখতে কৃশ হলে কী হবে, গায়ে জোর আছে। মেরীকে নতুন করে দেখামাত্রই আমার মনে একটা আকাক্সক্ষা ঘনিয়ে উঠলো। আচ্ছা আমি তো মেরীকে অনুবাদটা দেখাতে পারি। কিন্তু সাহস হয়নি। এইভাবে সাত-আট দিন আসা-যাওয়ার পর একদিন তাঁকে বললাম, আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে। আমি জানিনে কীভাবে নেবেন। আমি নিজের লেখা একটা উপন্যাস ইংরেজি করতে চেষ্টা করেছি। আপনি অনুগ্রহ করে যদি দেখতেন, কী পরিমাণ ভাষাগত ত্রুটি তাতে রয়েছে। মেরী বললেন, ঠিক আছে পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দিন পড়ে দেখবো। তিনি তিনদিন বাদে এসে বললেন, শতকরা দুই শতাংশ ভুল সংশোধন করতে হবে এবং তিন শতাংশ প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমি সাহস করে বলতে পারলাম না অনুগ্রহ করে কাজটি আপনি করে দেন। আমি বললাম তাহলে আমাকে একজন লোক খুঁজে বের করতে হবে যিনি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন। মেরী বললেন, আমিই কাজটা করতে পারি, কিন্তু তার জন্যে আপনাকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে রুটিন করে এসে আমার কম্পিউটারের সামনে বসতে হবে। একই সঙ্গে কম্পিউটারে ভাষা সংশোধন এবং প্রকাশভঙ্গি পরিবর্তনের কাজ দুইই করে ফেলবো। পনেরো দিনের মধ্যে মেরী পাণ্ডুলিপিটা নতুনভাবে কম্পিউটার টাইপ করে নিলেন। তখন আমাদের কাজ দাঁড়ালো ইংল্যান্ডে কিংবা আমেরিকার একটি প্রকাশনা সংস্থার সন্ধান করা, যারা আমার বইটা ছাপতে পারেন। মেরী এক কপি পাণ্ডুলিপি নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন আর এক কপি আমার কাছে রেখে গেলেন।

নিউইয়র্কে সলিমুল্লাহ খান নিউ স্কুলে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে কাজ করছিলো। আমি সলিমুল্লাহর সঙ্গে চিঠি মারফত মেরীকে যোগযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। মেরী সলিমুল্লাহর সহায়তায় অনুবাদটির আরো একটি সংশোধিত কপি তৈরি করেছিলেন। এই অনুবাদটি ছিলো মেরীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ সেতু। এ পর্যন্ত মেরীকে আমি যতো চিঠি লিখেছি এবং মেরী আমাকে যতো চিঠি লিখেছেন তা সংগ্রহ করে প্রকাশ করলে চারশ’ পাতার একটা বই দাঁড়িয়ে যাবে।

ড. ডানহাম সম্পর্কে আরেকটা বিষয়ে কিছু কথা বলে আমি এই রচনাটির ইতি টানবো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর গৃহনির্মাণ ব্যবস্থার প্রতি তিনি খুব গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। এক সময়ে এই সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, এ এলাকায় অধিকাংশ মানুষ গরীব। অধিকাংশ মানুষের ইট-সিমেন্ট-রড এগুলো ক্রয় করার সামর্থ্য থাকে না, কম খরচে কীভাবে গৃহনির্মাণের উপকরণ সংগ্রহ করা যায়, তাই নিয়ে তিনি মাথা ঘামিয়েছিলেন এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, মানুষ যদি চারপাশের প্রকৃতি থেকে গৃহনির্মাণের উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে কম খরচে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে উঠবে। তাঁর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এ ছিলো যে, এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণ বাঁশ পাওয়া যায়।

বাঁশের সংখ্যা কমে এলেও কীভাবে নতুন করে বাঁশের বংশবৃদ্ধি করা সম্ভব এ নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। অনেক খাটাখাটনি করে একটা পদ্ধতি তিনি বের করতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে চার বছরে বাঁশ যতোটুকু বাড়ে, তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসারে বাঁশ চাষ করলে, ছ’মাস সময়ের মধ্যে বাঁশের ততটুকো বাড় ঘটবে। বাঁশের ঘরের আরেকটা সমস্যা হলো, দীর্ঘদিন টিকে না। নানা রকম পোকার আক্রমণে বাঁশের বেড়া ঝাঁরা হয়ে যায়। বাঁশের বেড়াকে পোকার আক্রমণ থেকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে তার কতিপয় উপায় তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন।

প্রথমত বাঁশ চিরে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর বাঁশের সঙ্গে কতিপয় রাসায়নিক পদার্থের মিশেল দিতে হবে। তাহলেই বাঁশের বেড়া দীর্ঘকাল টেকসই থাকবে। তিনি তাঁর গবেষণা হাতে-কলমে প্রমাণ করা যায় কি না পরীক্ষা করে দেখতে দেড় বছর আগে মিয়ানমারে এসেছিলেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে অল্পদিনের মধ্যে তাঁকে দেশে ফিরতে হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলো অপরীক্ষিতই থেকে গেছে।

 

উৎস: এবিএম সালেহ উদ্দীন সম্পাদিত, আহমদ ছফা:ব্যক্তি ও সমাজ (ঢাকা: বাড পাবলিকেশন্স, ২০১১), পৃ. ১৪৯-৫৪
পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ১৯, ২৯ জুলাই ২০১৩

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।