বাঙ্গালি মুসলমানের মন (মূল পাঠ ১৯৭৬) — ৫

এই পুঁথিসমূহের দোভাষী—অর্থাৎ বাংলা এবং আরবি-ফারসিমিশ্রিত—হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। হাদিসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবিকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথমত কোরানের ভাষা আরবি। দ্বিতীয় কারণ বেহেশতের অধিবাসীদের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত হজরত মোহাম্মদ নিজে একজন আরবিভাষী ছিলেন। এই তিনটি মুখ্য কারণে যে সমস্ত দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে এই ভাষাটিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আরব অধিকারের পূর্বে মিশর এবং আফ্রিকার দেশসমূহের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা দু’ই ছিল। কিন্তু আরবদের অধিকারে আসার পর আরবি ভাষা এবং আরবি বর্ণমালা দুটিকেই অধিবাসীদের গ্রহণ করতে হয়।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবি ভাষা এবং ইসলাম অনেকটা অভিন্নার্থক ছিল। আরবি ভাষা গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণ করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না—সে সময়ে এরকম একটা প্রবল মত অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল। অন্য যে কোন সেমিটিক ধর্মের মত ইসলামেও পারলৌকিক জীবনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সারা জীবন মুসলমান হিশেবে জীবন কাটিয়ে পরকালে বেহেশতে গিয়ে ভাষাজ্ঞানের অভাবে একঘেয়ে জীবন কাটাতে হবে—এটা ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রেরই সহ্যের অতীত একটা ব্যাপার। তাই মিশর থেকে শুরু করে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা আরবি ভাষা এবং বর্ণমালা দুটিই গ্রহণ করেছিলেন।

মিশরে যেভাবে সহজে আরবি ভাষা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে ইরানে তেমনটি হতে পারেনি। কারণ ইরানিরা ছিলেন অতিমাত্রায় ঐতিহ্যসচেতন এবং সংস্কৃতিগতপ্রাণ জাতি। তাদের মহিয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে এ যুক্তি উদ্ধার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি যে আরবি ভাষা আয়ত্ত না করেও প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়। কোরানের প্রকৃত শিক্ষা তাঁদের ভাষায় বিকশিত করে তোলার মত ভাষাগত সমৃদ্ধি এবং মনীষা দুই-ই তাঁদের ছিল। আরবি ভাষা গ্রহণবর্জন প্রশ্নে ইরানি সমাজ যে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল কবি শেখ সাদী, দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি প্রমুখ তা গ্রহণ করেছিলেন।

ইরানিরা আরবি ভাষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু আরবি বর্ণমালা তাঁদের মেনে নিতে হয়েছে। তারপরে ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষ অবধি মুসলিম শক্তির যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে তার পেছন পেছন ফারসি ভাষাও ভারতে প্রবেশ করেছে। এমনকি মোগল বিজেতারাও তাঁদের মাতৃভাষা তুরকির পরিবর্তে ফারসিকেই সরকারি ভাষা হিশেবে মেনে নিয়েছেন। মিশরে আরবি যেমন, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে ফারসি যেমন চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে—ভারতবর্ষে অনেকদিন রাজভাষা থাকার পরও ফারসি সেভাবে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।

ভারতের হিন্দুরা বড় আশ্চর্য জাত, তারা দরবারে চাকরি করার জন্য উত্তমরূপে ফারসি ভাষা শিক্ষা করেছেন, ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো’ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে কখনো ঐ ভাষাটিকে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভারতে ফারসি ছিল জনগণের দৈনন্দিনতার স্পর্শলেশবর্জিত দরবারবিহারী একটি অভিজাত শ্রেণীর ভাষা। স্থানীয় মুসলিম জনগণের মধ্যেও তার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। স্বাতন্ত্র্যগর্বী মুসলমানেরা নিজেদের প্রয়োজনে ফারসি বর্ণমালা গ্রহণ করে ভারতীয় ভাষাসমূহের সমন্বয়ে উরদু নামে একটি পাঁচমিশালি ভাষা তৈরি করেছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যেমন রেনেসাঁস যুগে জাতীয় ভাষাসমূহের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পূর্বে ল্যাটিন ভাষায় সন্দর্ভ ইত্যাদি রচনা করতেন তেমনি মুসলিম ধর্মবেত্তারাও ধর্মগ্রন্থসমূহের টীকাটিপ্পনী ফারসি ভাষাতেই রচনা করতেন। সৈয়দ আহমদের আলিগড় আন্দোলনের পর উরদু ভাষায় নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয় এবং ঐ ভাষাতেই ধর্মীয় সন্দর্ভসমূহ লেখা হতে থাকে।

বাঙ্গালি মুসলমানের চোখে ফারসি এবং উরদু ভাষা দুটা আরবির মতই পবিত্র ছিল। আর এই দুটা রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায় তাঁদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য কোন সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিল দুটির কোনটিই তাঁদের ছিল না। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা যে ধরনের ইংরেজি বলেন কিংবা ঢাকার কুট্টি অধিবাসীরা যে উরদু বলেন ততটুকু ভাষাজ্ঞান অর্জন করাও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ইংরেজ এবং ইংরেজি ভাষার আর ঢাকার কুট্টিদের সঙ্গে উরদু এবং নবাবদের সামাজিক মেলামেশার যে সুযোগ ছিল, বাংলার আমজনগণের সঙ্গে উরদু-ফারসি জানা শাসক নেতৃশ্রেণীর সামাজিক মেলামেশার সুযোগ ততটুকু ছিল না।

কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে আরবি, ফারসি এবং উরদু এই তিনটি ভাষায় তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আরবি, ফারসি এবং উরদুভাষাটাও যখন তাঁদের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করা অসম্ভব মনে হয়েছে তখন ঐ বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন।

এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়ার আছে, কোন ব্যক্তিবিশেষ একটা [বিশেষ] ভাষা রপ্ত করতে পারেন কিন্তু সেটাকে সামাজিকভাবে রপ্ত করা  বলা চলে না। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও আরবি হরফে বাংলা পুঁথিপত্র যে লেখা হয়েছে সেটাকে কজন অবসরভোগী পুঁথিলেখকের নিছক খেয়াল মনে করলে ভুল করা হবে। আসলে তা ছিল বেহেশতের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিপ্রকাশ। যখন দেখা গেল আরবি হরফে বাংলা লিখেও সমাজে চালু করা যায় না তখন পুঁথিলেখকরা সবান্ধবে পরবর্তী পন্থাটা অনুসরণ করতে থাকলেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে এন্তার আরবি-ফারসি শব্দ মিশাল দিয়ে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করলেন। জনগণ তাঁদের এই ভাষাটিকে গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু কোন জনগণ? এরা সেই জনগণ সংস্কৃত ভাষা যাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, আরবি অজানা, যারা ফারসির নাম শুনেছেন [বটে] এবং উরদুভাষা কানে শুনেছেন মাত্র।

সুযোগ পেলে তারা আরবিতে লিখতেন, নইলে ফারসিতে, নিদেনপক্ষে উরদুতে। কিন্তু যখন দেখা গেল এর একটাও সামাজিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয় তখন বাধ্য হয়েই বাংলা লিখতে এসেছেন। কেউ কেউ সন্দ্বীপের আবদুল হাকিমের সেই:

যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি

পংক্তিগুলো আউড়ে বলে থাকেন যে নিজেদের ভাষার প্রতি পুঁথিলেখকদের অপরিসীম দরদ ছিল। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আবদুল হাকিমের এই উক্তির মধ্যে একটা প্রচণ্ড ক্ষোভ এবং মর্মবেদনা লক্ষ্য করা যায়। নিশ্চয়ই সে সময়ে এমন লোক ছিলেন যারা সত্যি সত্যি বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতেন। আবদুল হাকিম নিজে সে শ্রেণীভুক্ত নন, তাই সে উঁচুভাষাতে তাঁর অধিকারও নাই। তাই তিনি তাঁর একমাত্র আদি এবং অকৃত্রিম ভাষাতেই লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।

দূর অতীতের কথা বলে লাভ নেই। ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফও মুসলমান সমাজের শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে উরদু ভাষার সুপারিশ করেছিলেন। জনাব আবুল কাসেম ফজলুল হক—যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ তিনিও—বাড়িতে উরদু ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। ঢাকার কুট্টি অধিবাসীদের অনেকেই অনেকদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করেছেন। এই সমস্ত কিছুর মধ্য থেকে একটি সত্যই স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে। তা হল বাঙ্গালি মুসলমানদের অধিকাংশেরই মধ্যে আরবি ফারসি উরদু ইত্যাদি ভাষার প্রতি একটা অন্ধ অনুরাগ অনেকদিন পর্যন্ত বিরাজমান ছিল।

 

আহমদ ছফা বিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।