সৃষ্টিশীল আহমদ ছফা ও প্রজন্মের দায়বদ্ধতা–মুস্তাফিজ সৈয়দ

সৃষ্টিশীলতা মানুষকে বিশ্বের মাঝে সমগ্র জনতার নির্জনতার মুগ্ধতায় সরব অবস্থান তৈরি করে দেয়। সৃষ্টিশীলতার চর্চা যিনি করেন তিনিই সৃষ্টিশীল হিসেবে শিল্প-শৈলীগোষ্ঠীতে স্বীকৃত হোন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখের রৌদ্র ঝলমল শীতলদিনে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রফেসর মিছবাহুদ্দীন স্যারের সাথে কথা হচ্ছিল আমাদের দেশের অন্যতম বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার লিখিত গ্রন্থ ‘যদ্যপি আমার গুরু’ ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বই দুটি নিয়ে। দুটি বই পড়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি আহমদ ছফার রচনা শিল্প-শৈলীর বিশুদ্ধতায়। বিশুদ্ধতা বলছি এই জন্য তিনি আমার কাছে এক ভিন্নধর্মী মানুষ। মৌলভী ছফার (রাজ্জাক স্যার তাঁকে স্নেহ করে এ নামে ডাকতেন) ভিন্নতা আমাকে তাঁর সর্ম্পকে জানতে আগ্রহী করে তুলেছে।

শ্রীশচন্দ্র দাশের লেখা সাহিত্য সর্ন্দশন গ্রন্থেনন্দলাল বসু বলেন, ‘শিল্প সাধনায় শিল্পী সর্ম্পূণ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। আর্টিস্টের নিজের ব্যক্তিগত আবেগ, আকাঙ্খা, সংস্কার সবই আছে। কিন্তু এই মুহূর্ত সে একটি ভাবের আবেগে বিচলিত হচ্ছে আর পর মুহূর্তেই সৃষ্টি করতে বসে নিজের আবেগ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছে। সৃষ্টির সময় শিল্পী নিজের ব্যক্তিত্বের উর্ধ্বে চলে যায় এবং তার আবেগ থেকে রসে গিয়ে পৌঁছায়।’ যখন কোন মানুষ কোন সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম (সাহিত্য কর্ম, চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম ইত্যাদি) করে তখনই তাঁর পরিচিতি পায় সৃষ্টিশীল হিসেবে তবে সেই পরিচয় স্থায়ীরূপ লাভ করে সময়ের প্রবাহে, সাহিত্য সংস্কৃতির অনিন্দ্য আবহে। এর আগে আহমদ ছফার লেখা ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ উপন্যাসটি পড়েছি তখন মন্ত্র মুগ্ধতায় ডুবে ছিলাম যেন তাঁর লেখা হ্যামেলিয়নের বাঁশিওয়ালার অবিছিন্ন সুর। যখন তাঁর লেখা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বই দুটো পড়া হলো আমি আহমদ ছফাকে আবিষ্কার করলাম এক মহান দার্শনিক ও একজন সাহিত্য শিল্পী হিসেবে। তিনি সেই মাপের মানুষ যাঁর কোন তুলনা নেই, তিনি এমন এক লেখক যাঁর প্রশংসা করতেন শিক্ষকদের শিক্ষক জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।

১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্রগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অসামান্য প্রতিভাধর লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। তাঁর পিতার নাম হেদায়েত আলী ও মা আছিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে পিতৃ গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রজীবনের তারুণ্যের সূচনালগ্ন হতেই তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগ দেন। বিপ্লবী সূর্যসেনের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্রগ্রাম দোহাজারী রেললাইন উড়িয়ে দেন। ১৯৬২ সালে চট্রগ্রাম নাজিরহাট কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন এবং এই বছরে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যাননি। ছফা শিক্ষকদের সাথে অভিমান করেই বাংলা বিভাগ ছেড়ে দেন।

১৯৬৭ সালে বি-বাড়িয়া কলেজ হতে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ২য় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে এম.এ পরীক্ষা দেয়ার পূর্বেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির আবেদন করেন এবং তিনবছরের ফেলোশীপের জন্য মনোনীত হোন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এর প্রভাব। পিএইচডি গবেষণা কর্মের নিমিত্তে জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাথে পরিচিত হোন। ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এম.এ পরীক্ষা দেন এবং তাঁর মৌখিক পরীক্ষা হয় মার্চের ২১ তারিখে।

এই ছিল আহমদ ছফার একাডেমিক ক্যারিয়ার। আহমদ ছফা একাডেমিক শিক্ষা যতটা পেয়েছেন তাঁর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা ও বুদ্ধিবৃত্তির চির সৌন্দর্যময় জগত। তিনি যেমন উচ্চ স্তরের চিন্তনের অধিকারী ছিলেন তেমনি ছিলেন অতিমাত্রায় বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এবং মানবিক চেতনা সম্পন্ন। মানবিক মুক্তিই ছিল তাঁর হৃদয়ের নীরব কথা। আহমদ ছফার লেখনী যেকোন বয়সের পাঠকের কাছে চির সঞ্জীবনী চির যৌবনা চির অধরা অপ্সরী রূপের কিন্নরী। ওমর খৈয়ামের কবিতার ছন্দে- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বই সে অনন্ত যৌবনা।’ ছফা আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০০১ সালের ২৮শে জুলাই।

বুদ্ধিবৃত্তি ধারার জ্ঞান অন্বেষণকারীরা এখনো তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্য শৈলীতে ডুব দেয় নির্ভাবনায়, পরম আনন্দবিলাসে। ছফার লেখনী মাঝে তাজমহলের সৌন্দর্যের সাথে দারুণ মিল রয়েছে। তাজমহলকে বিভিন্ন দিক হতে দেখলে যেমন বিভিন্ন আঙ্গিকে এর রূপ ফুটে ওঠে তেমনি ছফা রচনাবলীও এমন সৌন্দর্যের নীরব উদাহরণ। সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যিকের মন, বস্তু-অবস্তুজগত ও নিজের প্রকাশভঙ্গি। মনের মাধুরী মিশিয়ে বস্তুজগতের নানা বিষয়ের ইতিবাচক প্রকাশভঙ্গির সরব অবস্থান সৃষ্টি করেছেন গণবুদ্ধিজীবী সমাজবিজ্ঞানী ছফা। আহমদ ছফা সমাজের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন, মানুষের উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা করতেন। এসব কিছুই তুলে ধরতেন তাঁর বিশ্লেষণধর্মী ক্ষুরধার লেখনীতে। তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি বরং রাষ্ট্রীয় পেশি শক্তির বিপক্ষে তিনি কলম শক্তির ব্যবহার করেছেন নিপুনভাবে। আমাদের দেশীয় শিক্ষার কথা নিয়েও তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ও সত্য প্রকাশকারী। ৭২/৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেমিনারে পাঠ করা আহমদ ছফার ‘শিক্ষার দর্শন’ প্রবন্ধটি। আমরা সবাই জানি যে শিক্ষার কাজ হচ্ছে মানুষের আচরণের কাঙ্খিত ইতিবাচক পরিবর্তন। আপনি আপনার নিজের কাছে প্রশ্ন রাখেন, আসলেই কি আমাদের আচরণের কাঙ্খিত পরিবর্তন হচ্ছে কিনা?

আমাদের দেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঠিক তবে এটাও বলতে হবে আমরা প্রকৃত মানবতার শিক্ষা থেকে এখনো বঞ্চিত আছি মানে সহজ কথায় বলতে হয় আমরা জাতিগতভাবে সার্টিফিকেট ও কর্মমুখী শিক্ষা অর্জন করছি অথচ মানবিকতার শিক্ষা খুব একটা নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের আচরণের কাঙ্খিত ইতিবাচক পরিবর্তন। আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমেই একজন মানুষ মানবিক হয়ে ওঠে। ছফার ‘শিক্ষা দর্শন’ প্রবন্ধে বলা হয়- ইউরোপীয় রেনেসাঁর পূর্বে শিক্ষার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল অতীন্দ্রবাদে প্রোথিত। ‘মানুষ জানবে কেন? বুঝবে কেন? জ্ঞান লাভ করবে কেন? এই সব কেন-র জবাব প্রাচীন জগত দিয়েছে- ‘কোন এক অলৌলিক সত্তায় তাকে বিশ্বাসী হতে হবে।’

মানুষ অজানাকে জানতে চায়, বুঝতে চায়। অজানাকে জানার মাধ্যমেই সত্তার পরিচয় আবিষ্কৃত হয়। প্লেটো গ্রিসে গার্ডিয়ানদের যেশিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পরমসত্তার স্বরূপ উপলদ্ধি। পরম সত্তার উপলদ্ধি বলতে ছফা বুঝিয়েছেন মানুষ যেন মানবিক হয়। মানবিকতার মাঝে শিক্ষার্থীরা খুঁজে পাবে পরম সত্তার সন্ধান। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায়- আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, সফল হচ্ছি কিন্তু কে কতটা মানবিক হতে পেরেছি। মানবিক হওয়াই শিক্ষার মূল লক্ষ্য তথা পরম সত্তার সানিধ্য লাভ। আহমদ ছফা অভিমত পোষণ করেন যে ‘পরম সত্তার বিষয়ের জ্ঞানের বলেই মানুষের সুস্থ সমাজ সৃজন সম্ভব।’ আমাদের ¯্রষ্টা তথা পরমসত্তার উপর আমাদের একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে ধাবিত হচ্ছে অন্ধকারের দিকে। মানুষজন শুধু একাডেমিক শিক্ষার দীক্ষা নিচ্ছে। ব্রহ্মজ্ঞানকে ধরা হত সকল জ্ঞানের কাণ্ড এবং সব জ্ঞান ডালপালা বিশেষ।

এজন্যই বলা হত – Ancient India is the pleasure filed of prior civilization. বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা নির্বাণ লাভ। বৌদ্ধযুগে শিক্ষা বলতে নির্বাণ লাভ বুঝানো হতো। নির্বাণ আসলে কি? নির্বাণ সর্ম্পকে জানতে হলে আমাদের সবার আগে জানা প্রয়োজন শিক্ষা কি? শিক্ষা হলো গতিশীল সামাজিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা ছকে বাধা কোন প্রত্যয় নয় বরং এর ব্যাপকতা অসীম। অসীমের মাঝে সীমারেখা টেনে শিক্ষাকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ করা যায় না। স্থান কাল পাত্র জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে বৈচিত্রময় চাহিদার আলোকে শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। মহামতি সক্রেটিসের মতে – ‘মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার হলো শিক্ষা।’ জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেন – ‘আর্দশ মনুষ্যত অর্জনই হল শিক্ষা। মিথ্যার ধ্বংশ, সত্যের আবিষ্কার কিংবা আর্দশ মানুষ হতে শেখা একজন মানুষকে শিক্ষিত করে তুলে। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষকে আসল মানুষে পরিণত করে তুলে।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রর্বতক গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থ। ৫৬৭ অব্দে নেপালের লুম্বিনী গার্ডেনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি যখন জন্ম করেন তখন ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, নিপীড়ন, দুঃসহ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। জনসাধারণের কষ্ট, দুঃখ গৌতম বুদ্ধের মনের মাঝে আলোড়ন তুলেছিল। কিভাবে তাদের এসব (দুঃখ, কষ্ট, জ্বরা, ব্যাধি, ক্ষুধা) থেকে মুক্তি দেয়া যায়। বিহারের গয়া নামক স্থানে বোধিবৃক্ষের নিচে ৭ বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন। অবশেষে সেখানে খুঁজে পান আলোর দিশা। সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার পর তিনি সবার মাঝে বুদ্ধ নামে পরিচিতি পান আর তাঁর অনুসারীরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হিসেবে পরিচিতি পায়। ‘বোধ’ শব্দের অর্থ হলো আলো বা জ্ঞান। গৌতম বুদ্ধ আত্মার বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বুদ্ধের মূল দর্শন ছিল পৃথিবী থেকে যে লোভ সম্বরণ করতে পারে সেই প্রকৃত সুখী। নির্বাণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- মানুষ যখন লোভের উর্ধ্বে উঠতে পারে তখন আত্মা নির্বাণ লাভ করে এবং প্রকৃত সুখী হয়। আত্মশুদ্ধি হচ্ছে র্নিবাণ লাভ। আত্মশুদ্ধি বা নির্বাণের ৮টি পন্থা রয়েছে- যথা ১. সৎ চিন্তা ২. সৎ উদ্দেশ্য ৩. সৎ বাক্য ৪. সৎ কর্ম ৫. সৎ জীবন যাপন ৬. সৎ চেষ্টা ৭. সৎ সংকল্প ৮. সৎ ধ্যান। এতো গেল বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার মূলকথা। যুগে যুগে বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র বদলে গিয়েছে।

পৃথিবীতে যখন ইসলামে প্রবর্তন হলো এসময় লোকেরা কুরআনের উপর আস্থা স্থাপন করে এবং ইহকাল-পরকাল নিদ্বিধাহীন বিশ্বাস স্থাপন করার শিক্ষা দেয়া হতো তাই আর্দশ শিক্ষা বলে বিবেচিত হতো। ধর্মীয় বিচার, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে শিক্ষার রূপ প্রতিনিয়ত বদলে গিয়েছে। জাতিগত বিদ্বেষ কিংবা যেকোন সম্প্রীতি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনেকটা প্রভাবিত করেছে। যাকে কেন্দ্র করে আমার লেখার সূত্রপাত তিনি হলেন জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের কাছের মানুষ আহমদ ছফা। শুধু আব্দুর রাজ্জাক স্যারের কাছের মানুষ বললে ভুল কেননা ছফা এখনো নানা বয়সী মানুষের বিশেষ করে তরুণ গৌষ্ঠীর মাঝে চিরনন্দিত কথাসাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইটিতে তিনি নানা বিষয়ে প্রবন্ধ আকারে লিখেছেন। এর মধ্যে একটি প্রবন্ধ ছিল শিক্ষার দর্শন। প্রবন্ধটিতে তিনি তুলে ধরেছেন শিক্ষার নানা দর্শন। শিক্ষা যুগে যুগে কিভাবে বদলে গিয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব, শাসক গৌষ্ঠীর প্রভাব ইত্যাদি কারণ আমাদের দেশ নানা সময়ে নানা দেশের শাসকের দ্বারা শাসিত হয়েছে। শাসকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলণ করেছিল।

আহমদ ছফার লেখা সর্ম্পকে তাঁরই শিক্ষকজ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার বলেছেন, ‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যেকোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারবে।’ এই ছিল গুরুর কাছে প্রিয় শিষ্যের সাহিত্যকর্মের যথার্থ মূল্যায়ন। কতটা আপন করেই নিতে পেয়েছিলেন বলেই শিষ্য সর্ম্পকে এমন দরদমাখা উক্তি করতে পেরেছিলেন রাজ্জাক স্যার। আহমদ ছফার রচনাসম্ভার সৃষ্টিশীল এবং পরিপূর্ণ। ড. সলিমুল্লাহ খানের ভাষ্যমতে- ‘কাজী নজরুল ইসলামের পরে বাংলা সাহিত্যে আহমদ ছফাই শ্রেষ্ঠ মুসলমান লেখক।’ আহমদ ছফার রচনাসম্ভার যেন সমুদ্র জলবক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনিমুক্তো। তাঁর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘সূর্য তুমি সাথী’ (১৯৬৭), ‘দোলো আমার কনকচাঁপা’ (১৯৬৮), ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ (১৯৭১), ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭২), ‘জল্লাদ সময়’ (১৯৭৫), ‘দুঃখের দিনে দোহা’ (১৯৭৫), ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ (১৯৭৯), ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৮১), ‘গো-হাকিম’ (১৯৭৭), ‘ফাউস্ট’ (মূল- জার্মান লেখক য়োহান ভোলফ্ গাঙ ফন গ্যোতে-১৯৮৬), ‘একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন’ (১৯৮৯), ‘মরণবিলাস’ (১৯৮৯), ‘অলাতচক্র’ (১৯৯৩), ‘গাভী বিত্তান্ত’ (১৯৯৫), ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ (১৯৯৬), ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ (১৯৯৬), ‘যদ্যপি আমার গুরু’ (১৯৯৮), ‘লেনিন ঘুমাবে এবার’ (১৯৯৯), ‘বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ (২০০১) ইত্যাদি।

আহমদ ছফার মৃত্যুর ১৯ বছর হলো তবুও তিনি পাঠকমহলে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার পথে যেন শুদ্ধ প্রতীক, অবিশ্বাস্য আলোক ধারার বাতিঘর। সেই বাতিঘর হতে এখনো আলো জ্বলছে স্বপ্রতিভ মহিমায় আর সেই আলোরেখায় উৎসুক ছফামুখী মানুষেরা খুঁজে নেয় বুদ্ধিবৃত্তির বিন্যাসের নবনির্যাস। যে নির্যাসে প্রাণের মাঝে, মনের মাঝে সঞ্চারিত হয় এক অমীয়ধারা। বুদ্ধিবৃত্তি ও শৈল্পিক কথাসাহিত্যের অমর নাম আহমদ ছফা, আমরা তাঁর কাছে জাতিগতভাবে ঋণী। আহমদ ছফার কাছে প্রজন্মের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা আসলে কি? প্রজন্মের দায়বদ্ধতা হলো ছফা যেমনটা চেয়েছেন তেমনটা না হোক অন্তত এ প্রজন্মে আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে নিজেকে মানবিক হিসেবে গড়ে তুলি। মানবিকতা হলো মানুষের মুক্তি আর পরম সত্তার সন্ধান লাভ।

একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক করাই শিক্ষার মূল্য লক্ষ্য। আর্দশ মনুষ্যত্ব অর্জনই হলো শিক্ষা। যখন একজন শিক্ষার্থী আর্দশ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে তখন সে এমনিতেই মানবিক হয়ে ওঠবে কেননা মানবিকতা ছাড়া আর্দশ মনুষ্যত্ব অর্জিত হয় না। আর্দশ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে গেলে অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তির সৃজনময় বিন্যাস করবে। সেই বিন্যাস ও আর্দশ মনুষ্যত্ব অর্জনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও প্রজন্মের দায়বদ্ধতার হিসাব কষে নতুন বৃদ্ধিবৃত্তির জাগরণ হবে এবং আরো জন্ম হবে আগামী প্রজন্মের নয়া ছফার। রূপসী বাংলার আহমদ ছফা বেঁচে থাকবেন তাঁর বৃদ্ধিবৃত্তির অসীম ভাবনার মহাজাগতিক কালের রেখায়।

লেখক:
মুস্তাফিজ সৈয়দ
শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব এডুকেশন, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সিলেট।
ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০১৫।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।