বস্তি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়

 

আহমদ ছফার এই রচনাটি পরপর দুই কিস্তিতে ছাপা হইয়াছিল অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় — ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে, যথাক্রমে ১৪ আর ২৮ তারিখে। যতদূর জানি, তাঁহার অন্য অনেক সাময়িক লেখার মত এই লেখাটিও লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত কোন নিবন্ধ সংগ্রহে গ্রহণ করা হয় নাই। আহমদ ছফার ষোড়শ প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সম্পাদনার পর লেখাটি এখানে একটি অখণ্ড নিবন্ধ আকারে ছাপা হইতেছে।

 

জীবনের উপান্তে পৌঁছিয়া আহমদ ছফা অনেক সময় আর নিজের হাতে লিখিতেন না, মুখে মুখে বলিয়া যাইতেন। যাহারা লিখিয়া লইতেন তাহাদের সকলের জ্ঞান ও গরিমা সমান মাপের ছিল না। তাই মাঝে মধ্যে আমরা খানিক হাসিবার সুযোগও পাইতাম। হাসির কারণ একটা উদাহরণ দিলেই বুঝা যাইবে। এই নিবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তির একেবারে প্রথম বাক্যেই ছাপা হইয়াছিল: ‘এ রচনাটির গত সংখ্যায় আমি কিছু শঙ্কার উল্লেখ করেছিলাম। আমি দাবি করতে পারবো না আমার উদ্ধৃত সংখ্যাগুলো যথাযথ।’ ‘গত সংখ্যায়’ — মানে প্রথম কিস্তিতে — দেখিলাম তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন শুদ্ধমাত্র কিছু ‘সংখ্যার’। শ্রুতিলেখকের গুণে ‘সংখ্যার’ শব্দটি হইয়া গিয়াছে ‘শঙ্কার’।

 

ইতি সলিমুল্লাহ খান

২৬ জুলাই ২০১৭

 

ঢাকা শহরের বস্তিতে কত মানুষ থাকে? ঢাকা শহরের মোট লোকসংখ্যা কত? ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে কত মানুষ বসবাস করে? ঢাকা শহরে গড়পড়তা প্রতিকাঠা জমির মূল্য কত? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া রীতিমত অসম্ভব। সরকারি তরফ থেকে যে সংখ্যাতাত্ত্বিক হিশাব পাওয়া যায় সেটার ওপর কোন বুদ্ধিমান লোকের আস্থা রাখা উচিত নয়। কারণ সরকার বাহাদুরের অফিসাররা যে সমস্ত সংখ্যাতত্ত্ব তৈরি করেন সেগুলোর মধ্যে যথার্থতার পরিমাণ খুবই অল্প।

ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা যদি আনুমানিক এক কোটি হয়, বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ন্যূনপক্ষে পঁয়ত্রিশ লাখ। এই পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ কচুরিপানার মত দল বেঁধে শহরের আনাচে-কানাচে কোণা-কাঞ্চিতে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করে। এখান থেকে তুলে দিলে সেখানে যায়, সেখান থেকে তুলে দিলে অন্যখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমিকভাবে বস্তি উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলেছে। কিন্তু তারপরেও এ শহরে বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে।

বস্তির জনসংখ্যা কেন বাড়ছে তার কারণ আমরা সকলেই জানি। সরকারের লোকদেরও অজানা থাকার কথা নয়। গ্রামদেশে নদীভাঙ্গা এবং আরও নানাবিধ কারণে ক্রমাগতভাবে নিঃস্ব হওয়া মানুষগুলোর যখন গ্রামে টিকে থাকার সামান্যতম অবলম্বনও অবশিষ্ট রইল না [তখন] তাদের শহরের পথে পাড়ি দিতে হল। এগুলো কমবেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সরকারের কি কারণে বস্তির ওপর ক্রমাগত আক্রমণ শানাতে হচ্ছে তার কারণটি আমরা জানি না। সরকার এ বস্তির মানুষগুলোর সঙ্গে যেভাবে ফাঁদে ধরা পশুর মত আচরণ করছে তার কারণ কি হতে পারে আমরা বুঝে উঠতে পারিনি।

বস্তির মানুষের ঢাকা শহরে বাস করার অধিকার ন্যায়ত রয়েছে। সে ব্যাপারে বর্তমান নিবন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে চাই। আমাদের জাতীয় বাজেটের শতকরা আশি ভাগ অর্থ আমরা বিদেশ থেকে দান-খয়রাত এবং ঋণ ইত্যাদির আকারে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে পেয়ে থাকি। পেয়ে থাকি আমাদের দরিদ্র মানুষদের দেখিয়ে। সে সাহায্য যখন আসে দরিদ্র মানুষের কাছে তার কানাকড়িও পৌঁছায় না। অতিখাওয়া মানুষরা প্রাপ্ত সাহায্যের প্রায় সবটাই আত্মসাৎ করে ফেলে।

শহরগুলো যত প্রসারিত হচ্ছে, অট্টালিকার সংখ্যা যত বাড়ছে, রাস্তাঘাট যত চকচকে এবং সুন্দর হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের নিঃস্বতা ও দরিদ্রতা সে পরিমাণে বাড়ছে। দরিদ্র মানুষদের দেখিয়ে প্রতিবছর যে পরিমাণ টাকা আমরা — দান এবং ভিক্ষা ইত্যাদির আকারে — এনে থাকি তার সিংহভাগ এ শহরগুলোর চাহিদা মেটাতে ব্যয় করতে হয়, গ্রামের জীবনব্যবস্থা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। কিছুসংখ্যক মানুষের [পক্ষে] গ্রামে জীবনযাপন একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনিবার্যভাবে তাদের শহরে আসতে হয়।

শহরে না এসে বাপ-পিতামহের ভিটিতে জীবন কাটাতে পারলে এ মানুষগুলো নিজেদের ভাগ্যবান মনে করত। কিন্তু সে ভাগ্য নিয়ে তাদের জন্ম হয়নি, তাদের শহরে আসতে হয়। শহরে আসার অধিকার তাদের আছে, তাদের দেখিয়ে যে অর্থ প্রতিবছর আসে তার বিরাট [একটা] অংশ শহর খেয়ে ফেলে — সুতরাং শহরে যে অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহ চলে তাতে তাদের একটা ন্যায্য হিস্সা রয়েছে। নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করলে এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

বর্তমান সরকার বস্তিবাসী মানুষের ওপর শত্রুরাজ্যের মানুষের মত আচরণ করছে। এটা অন্যায়, এটা জুলুম। এই অন্যায় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে এখানে কোন সংগঠিত রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিবাদ নেই। এটাই আমাদের রাজনীতির সবচাইতে বড় অপরাধ।

জার্মানিতে গ্রিনপার্টি বলে একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটেছে বেশ কিছুদিন আগে। এই দলটির পেছনে একটি দর্শন ক্রিয়াশীল। তা হল এই : একজন মানুষ যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে তার জীবনধারণের জন্য যেটুকু জমির প্রয়োজন অতটুকু জমি নিয়েই সে পৃথিবীতে জন্মায়। অত্যাচারী মানুষেরা আইন-কানুন, বিধিনিষেধ এইসব রচনা করে সে মানুষদের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে।

গ্রীনপার্টি যখন এই তত্ত্ব উপস্থিত করেছিল সকলে তাদের মনে করেছিল উন্মাদ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জার্মানি এবং পশ্চিম ইউরোপের কতিপয় দেশে গ্রীনপার্টির মতবাদ আশাতীত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বর্তমানে জার্মান পার্লামেন্টে গ্রীনপার্টির অবস্থান তৃতীয় স্থানে। ভবিষ্যতে সংসদে তারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবেন — একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশে সমাজবিপ্লবের প্রতি অঙ্গীকারসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা একটি-দুটি নয় — অনেক। তাদের ক্ষমতা যত অল্প হোক, পেছনে জনসমর্থন যত অকিঞ্চিৎকর হোক, সেটা বেদনার কথা নয়। বেদনার কথা হল মানুষের অধিকার বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে তাদের বেশির ভাগের মনে কোন ধারণাই জন্মেনি।

আমার এ কথাটা অনেকেই অমূলক [মনে করতে পারেন]। কিন্তু তারপরেও আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরতে চাই। ঢাকা শহরে এক কাঠা জমির গড়পড়তা মূল্যের পরিমাণ কত? ঢাকা শহরের সব জমির মূল্য সমান নয়। কোথাও বিক্রি হয় কাঠা আশি হাজারে, কোথাও বিশ লাখে। সুতরাং গড়পড়তা ধরে নিলাম মূল্য পাঁচ লাখ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক কাঠা জমি কত টাকায় বিক্রি হয়? পাঁচ হাজার টাকায়ও নয়। একটি হিশাব কষলে দেখা যাবে ঢাকা শহরে ছড়িয়েছিটিয়ে যত জমি রয়েছে — টাকার অংকে হিশাব করলে দেখা যাবে — এই জমির মূল্যটা সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সমস্ত জমির মূল্যের চাইতে অনেক বেশি।

আমরা একটা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মধ্যে বসবাস করি। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মানুসারে টাকা জমি হয়ে উঠতে পারে—আবার টাকার পরিণতিও হতে পারে জমিতে। কথাটা বুঝিয়ে বলি — ধরুন, আমার একটা বাড়ি আছে গুলশানে নগদমূল্যে যার দাম দাঁড়াবে দুই কোটি টাকায়। [তা] বেচে আমি গ্রামদেশে গিয়ে এই টাকায় পঞ্চাশ হাজার বিঘার একটি পুরা গ্রাম কিনে ফেলতে পারি। আবার ধরুন, আমার পঞ্চাশ হাজার বিঘার যে জমি আছে সে জমি বেচে সব টাকা এক করে গুলশানে একটা বাড়ি কিনে ফেলতে পারি।

আমাদের ভূমিব্যবস্থার মধ্যে যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সরকারি আইনানুসারে গ্রামাঞ্চলে একজন মানুষ সর্বোচ্চ ত্রিশ বিঘা জমির মালিক হতে পারে। প্রতিবিঘা বিশ হাজার টাকা দাম ধরলে [যার] সর্বমোট মূল্য দাঁড়াবে ছয় লাখ টাকা।

অর্থাৎ দেশের আইনানুসারে [গ্রামের] একজন মানুষ সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকার মালিক হতে পারে। কিন্তু শহরের এই চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। [শহরে] একজন মানুষ ইচ্ছে করলে একশটি দুইকোটি টাকা মূল্যের বাড়ির মালিক হতে পারে। সরকারের কাছে ট্যাক্স দিলে কেউ তার বাড়ির মালিক হওয়া ঠেকাতে পারবে না। এইখানে দেখা যাচ্ছে শহরে একজন মানুষ ভূমি বাবদ পাঁচশ কোটি টাকার মালিক হলেও সরকারি আইনানুসারে সেটাকে ন্যায়সঙ্গত এবং বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দেশের ভূমিব্যবস্থার ভেতরে এই যে এত বড় একটা অনিয়ম লুকিয়ে আছে সে জিনিশটা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। ভূমি-সংস্কারের কথা বললে সকলে গ্রামের ভূমি-সংস্কার করতে বলে। কিন্তু শহরের ভূমি-বণ্টনব্যবস্থার মধ্যে একটা র‌্যাডিকাল পরিবর্তন আনার কথা এই দুর্বল মস্তিষ্কের লোকেরা কখনো চিন্তার মধ্যেও আনে না।

আরো একটা বিষয় উত্থাপন করি। ঢাকা শহরের শতকরা তের শতাংশ মানুষ আটাত্তর শতাংশ ভূমির মালিক। ব্রিটিশ আমলে ঢাকা শহরের আয়তন ছিল কয়েক বর্গমাইলের মধ্যে সীমিত। লালবাগ থেকে চকবাজার, সদরঘাট, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা হয়ে টিকাটুলী এবং পুরানা পল্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিগত ৫০০/৭০০ বছরের ঢাকা শহর এতটুকু আয়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে মাত্র ৫০/৬০ বছর সময়ের মধ্যে বাড়তে বাড়তে ঢাকা শহর একদিকে টঙ্গী ও নয়ার হাট আর অন্যদিকে মাওয়া এবং নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে।

এই সময়ের মধ্যে ঢাকার স্ফীতি একশ গুণকেও ছাড়িয়ে গেছে। এরশাদ আমলের ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী শেখ শহীদ সংসদে দাঁড়িয়ে একটি কথা কবুল করেছিলেন। সরকার যে সমস্ত জমি ইতিপূর্বে হুকুমদখল করে নিয়েছে শতকরা চুয়ান্ন ভাগ মানুষ সে সকল জমির কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। আর হুকুমদখল করার সময় সরকার জমির যে মূল্য ধার্য করেছিল তা আসল মূল্যের চাইতে অনেক কম। পরে যখন সরকার এই জমি প্লট ভাগ করে বিক্রি করে তখন জমির যা দাম হওয়া উচিত ছিল তার চাইতে অনেক কম দামে [সে জমি] সুবিধাভোগী মানুষদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। অদ্যাবধি এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা — এ সমস্ত এলাকায় বিশেষভাবে রাজনৈতিক অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্লট বণ্টন করা হয়ে থাকে।

আরো একটা বিষয়ে আসি। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের কয়েকটি বনেদি শহরের কথা বাদ দিলে অন্যান্য [সকল] আধুনিক নগরে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন জমি নেই। এমন কি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির সমস্ত ভূমির মালিক দিল্লির নিগম কিংবা পুরসভা। যে কোন ধনী ইচ্ছে করলেই শহরে আলিশান অট্টালিকা বানাতে পারে না।

আমাদের ঢাকা শহরে পঁয়ত্রিশ লাখ লোক বস্তিতে থাকে, দশ লাখ লোক রাস্তায় ঘুমায়, পঁয়তাল্লিশ লাখ লোক মানবেতর পদ্ধতিতে ঘুপরি-ঘাপরি গৃহে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। আর বিশ লাখ লোক কোনরকমে হাতপা ছড়িয়ে বাস করার সুযোগ পায়। ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা এবং উত্তরা — এ সকল অঞ্চলে একবিঘা দুবিঘা প্লটের ওপর একতলা-দুতলা তিনতলা বাড়ি তৈরি করে যে সমস্ত পরিবার বসবাস করে সে রকম [ব্যবস্থা] দুয়েকটি বাদে পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে কদাচিত দেখা যায়। একবিঘা-দুবিঘা প্লটের বাড়িতে আমাদের এখানে ৮/১০ জন মানুষ থাকে। অন্যত্র দেখা যাবে এই পরিমাণ জমিতে অন্তত দুহাজার মানুষ বসবাস করে।

ঢাকা শহরে জমির পরিমাণ লোকসংখ্যার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। অথচ এখানে এক বিঘা, দুই বিঘা প্লটের ওপর বাড়ি তৈরি করে জমির সদ্ব্যবহার রোধ করা হয়। যে শহরে বিশ লাখ মানুষ বস্তিতে থাকে, দশ লাখ লোক রাস্তায় ঘুমায়, সেই শহরে হাতে গোনা দশ হাজার মানুষ আলিশান জমকালো অট্টালিকা তৈরি করে — তের ভাগ মানুষ হাতে আটাত্তর ভাগ জমি কব্জা করে নেয় — তার চাইতে কোন বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। সরকারী এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই অন্যায় ব্যবস্থাটি তৈরি করা হয়েছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ভূমি-ব্যবস্থার বৈপ্লবিক সংস্কার নয় — মামুলি গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশ্ন উঠলেও ঢাকা শহরের ভূমি বণ্টনব্যবস্থার মধ্যে একটা চূড়ান্ত ভাঙ্গচুর হওয়া উচিত।

এই অন্যায় ব্যবস্থাটিকে সবগুলো সরকার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে এবং সে কারণে তাদের বারবার বস্তি উচ্ছেদের কাজে হাত দিতে হচ্ছে। কিন্তু বস্তি উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশের জায়মান রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি থেকে বস্তি জন্ম নিয়েছে।

পরিশেষে মৎলিখিত একটি কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে এ রচনার ইতি টানব।

… আমরা যাব না গ্রামে
শিশু কি কখনো যায় মাতৃজরায়নে?
দলিত মথিত হব হাড়ে হাড়ে পিষ্ট হব
বিষাক্ত ভীমরুল প্রায় গুপ্তঘরে
সারারাত করে রব চুপ।
রজনী প্রভাতকালে বহির্গত হব সব
যেন ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান।
হে শহর, গর্বোদ্ধত নিষ্ঠুর শহর,
তোমার সংকীর্ণ বক্ষে সবান্ধবে একদিন
ঢেলে দেব মারাত্মক আজব কহর,
গ্রামখারিজের শোধ নেব, সোনালী শস্যের
নামে লাগাবো তান্ডব, বইয়ে দেব রক্তনদী
লালে লাল হবে রাজপথ, ক্ষেপা তরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে
খুলে নেব সভ্যতার ফ্যাকাশে বল্কল।
(ছফা ২০০০ : ১০৯-১১০)

এ রচনাটির গত সংখ্যায় আমি কিছু [সংখ্যার] উল্লেখ করেছিলাম। আমি দাবি করতে পারব না আমার উদ্ধৃত সংখ্যাগুলো যথাযথ। তারপরও আমার রচনার মূল যে সুরটি তাতে দ্বিমত করার কোন কারণ নেই। গত সংখ্যায় যে কথা বলেছিলাম সংক্ষেপে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

ঢাকা শহরে শতকরা তের ভাগ মানুষ আটাত্তর শতাংশের অধিক জমির মালিক, এই শহরে অন্তত চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করে, অন্তত পনের লাখ লোক রাস্তায় ঘুমায়। পৃথিবীর কয়েকটি বনেদি শহর বাদে বড় বড় শহরগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন জমি নেই। নগর কর্পোরেশনই সমস্ত জমির মালিক। সেখানে কোন ধনীব্যক্তি খেয়াল-খুশিমাফিক বাড়িঘর তৈরি করতে পারে না। অথচ ঢাকা শহরের বিশাল এক অংশে এককাঠা-দুকাঠা জমির ওপর ব্যক্তিমালিকানায় দুতলা-তিনতলা বাড়িঘর তৈরি করা হয়ে থাকে। জমির এত বড় অপচয় পৃথিবীর খুব কম শহরেই দেখা যায়।

দুবিঘা জমির উপর যেখানে বাড়ি করে পরিবারের ছয়-সাতজন লোক বাস করে সেই একটি জায়গায় বড় বড় শহরগুলোতে অন্তত এক হাজার মানুষ বাস করে। আমাদের জমির অভাব অত্যন্ত প্রকট আর জমির অপচয় তারও চেয়ে বেশি প্রকট। আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো অনেকদিন যাবত গ্রামের ভূমি-সংস্কারের কথা বলে আসছে। ভূমি-সংস্কারের নামে ভূমি-ব্যবস্থার মধ্যে স্বল্প চুনকামও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে জমি ভূমিহীন মানুষের দখলে আসেনি।

কিন্তু একটা বিষয় আমরা সত্যি সত্যি বুঝতে অক্ষম, ভূমি-সংস্কারের কর্মসূচিটি শুধু গ্রামের ওপর প্রযোজ্য কেন হবে? রাজনৈতিক দলগুলো শহরের ভূমি-সংস্কারের প্রশ্নটি ওঠায় না কেন? তথাকথিত প্রগতিশীল দলগুলো ভূমি-সংস্কারের সঠিক সংজ্ঞাটি এখনো অধিগত করতে সক্ষম হয়নি। এ রচনার পূর্ববর্তী অংশে আমরা বলার চেষ্টা করেছি — আমরা একটি ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি। এখানে টাকা এবং জমির মধ্যে মূলগত ফারাক নেই। মোটামুটি একটা গড় হিশাব করে দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম এ ঢাকা শহরে যত জমি আছে তার নগদ যা দাম সেটা বাংলাদেশের বেবাক জমির দামের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি।

গ্রামাঞ্চল থেকে অসহায় মানুষ শহরে আসছে — আসতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ গ্রামে টিকে থাকার [সামান্যতম] অবলম্বনও তাদের নেই। শহরে আসার নৈতিক অধিকার তাদের রয়েছে। বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রটির বার্ষিক আয়-ব্যয়ের যে বাজেট তার শতকরা আশি ভাগ টাকা আমরা এই গরিব মানুষদের দেখিয়ে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে দান-অনুদান, খয়রাত ইত্যাদির আকারে লাভ করে থাকি। সুতরাং ভূমিহীন লোকদের এই প্রজাতন্ত্রে বাঁচবার অধিকার থাকবে না কেন?

সরকার প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা — এসব অছিলায় ক্রমাগত বস্তি উচ্ছেদ করে যাচ্ছে। তার পরেও শহরে বস্তির সংখ্যা কমেনি বরং দিন দিন বাড়ছে। কেন বাড়ছে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করলে তার কারণগুলো জানা যাবে।

বস্তি-সমস্যা একা বাংলাদেশের [সমস্যা] নয়। তৃতীয় বিশ্বের যে সব দেশে দ্রুত নগরায়ন ঘটছে [সে সব দেশে] পাশাপাশি বস্তিও জন্ম নিচ্ছে। এটা একটা জবরদস্তিমূলক অর্থনেতিক ব্যবস্থার এপিঠ এবং ওপিঠ। অন্যান্য দেশে বস্তির নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সমর্থনে প্রগতিশীল এবং মানবতাবাদী রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তিসমূহ বস্তির মানুষের অধিকারের দাবিতে সক্রিয় এবং সোচ্চার থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বস্তির মানুষের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে বস্তির মানুষদের সঙ্গেই বস্তিতে বসবাস করছেন।

পাশাপাশি আমাদের অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করতে বলি। আমাদের গুণধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ নাসিম তাঁর শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন করার জন্যে সেই যে বস্তির ওপর একের পর এক হামলা করতে থাকলেন, একের পর এক বস্তি ভাঙ্গতে থাকলেন — এবং বক্ষপ্রদেশ উন্মুক্ত করে বীরত্ব জাহির করতে থাকলেন — কোন মহৎ আকাঙ্ক্ষা তাঁকে এ মহৎ-কর্মতাড়িত করে নিয়ে গেছে তার কোন কারণ তো আমরা খুঁজে পাই না। এই অসহায় রুগ্ন, দরিদ্র, দিন আনে দিন খায় [এমন সব] মানুষের বাসা ভাঙ্গার প্রবৃত্তি তাঁর হচ্ছে কেন তার কোন কারণ তো আমরা খুঁজে পাই না। আমি অবাক হয়ে ভাবি, নাসিম সাহেব শুধু কি দুর্বৃত্তপনার একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যই এ বীরত্ব প্রদর্শন করে যাচ্ছেন!

বস্তি উচ্ছেদ করার সময় নানারকম কারণ দেখানো হয়েছিল। [বলা হয়েছিল] শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, শহরে দুষ্কৃতিকারীর সংখ্যা বাড়ছে, শহরে আইনশৃঙ্খলার অধঃপতন ঘটছে — এসব কারণে শহরকে ভদ্রলোকের বাসযোগ্য করার মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়েই নাসিম সাহেব বস্তির ওপর হামলা করে যাচ্ছেন।

আমরা জানি — এবং নাসিম সাহেবও ভালো করে জানেন — এগুলো আসল কারণ নয়। বস্তি উচ্ছেদ করা হচ্ছে, বস্তিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে [অন্য কারণে]। বস্তিবাসীদের ছেড়ে দেয়া জমিজমা কারা অধিকার করছে, কাদের দখলে যাচ্ছে — সেটাই দেখার বিষয়। নাসিম সাহেব নিজেও জানেন ভালো বস্তিতে আগুন লাগিয়ে যারা বস্তির ওপর নিজেদের দখল কায়েম করে তারা কারা। আমি সাহস করে বলতে চাই, তারা নাসিম সাহেবের নিজের লোক।

আমার এ রচনাটি প্রায় শেষ করে এনেছি। আমি মোদ্দাকথায় যা বলতে চাই, বস্তির লোকদের উচ্ছেদ করে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করে তোলা কোনদিন সম্ভব হবে না। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য ঢাকা শহরের ভূমি বণ্টনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। যে তের শতাংশ মানুষের দখলে আটাত্তর শতাংশ জমি চলে গেছে তার মধ্যে যদি পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয় ঢাকা শহর একটি নরককুণ্ডে পরিণত হতে বাধ্য হবে।

দোহাই
১. আহমদ ছফা, ‘বস্তি উজাড়’, আহমদ ছফার কবিতা (ঢাকা : শ্রীপ্রকাশ, ২০০০, পৃ. ১০৪-১১০)।

 

পুনর্মুদ্রণ: এনটিভি অনলাইন, ২৮ জুলাই ২০১৭।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।