ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন নরপতি শশাংকের সময়ে বাংলা অঞ্চলে যথার্থ অর্থে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শশাংক বাঙ্গালি ছিলেন [এমন] নিশ্চিত অকাট্য প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেননি। পাল সাম্রাজ্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল শাসকদের প্রায় চার শতাধিক বছরের শাসনের সময়ে এই বাংলা অঞ্চলে একটি জাতীয়তার উন্মেষ হয়েছিল সে ব্যাপারেও কোন স্থিরনিশ্চিত প্রমাণ নেই। এক সময়ে বৌদ্ধধর্ম একটা সর্বভারতীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাল রাজন্যবর্গের রাষ্ট্রচিন্তাতেও সর্বভারতীয় ধর্মচিন্তার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল নির্ণয় করা মুশকিল। আজকের দিনে ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ বাঙ্গালির জাতীয় রাষ্ট্রের পেছনের ভিত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাল রাজাদের সময়ের কথা উল্লেখ করে থাকেন। তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ঘটনার টানাপোড়েন, ইতিহাসের রাজ্য ভাঙ্গাগড়ার ঘটনা [আর] ওই ঐতিহাসিক অতীতকে নতুনভাবে বর্তমান জাতীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রকল্পটির মধ্যে প্রকৃত সত্যের পরিমাণ কতদূর [আর কতদূর] কল্পনা স্থিরনিশ্চিত হয়ে সে বিষয়ে কিছু বলার উপায় নেই।
ইতিহাস কোন খাপছাড়া ব্যাপার নয়। অতীতের পারম্পর্যসূত্র সঠিকভাবে অনুধাবন না করে বর্তমানের ঘটনার মূল্যায়ন করলে সেটি অযথার্থ হতে বাধ্য। উনিশশ একাত্তর সালে বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয় যে স্বাধীন রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছিল তার পেছনের ইতিহাস-পরম্পরা অদ্যাবধি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে সেটি সম্ভবও নয়। কোন বড় ঘটনা ঘটে গেলে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যা হোক, এখানে একটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রাষ্ট্রের গন্তব্য কোথায় এবং চ্যালেঞ্জসমূহ কি কি সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সর্বসম্মত কোন মতামতও তৈরি হয়নি। বিতর্ক চলছে এবং অনেকদিন পর্যন্ত চলবে।
ইতিহাসের ঊষাকাল থেকেই বাংলা তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে গেলেও বেশির ভাগ সময়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব অগ্রাহ্য করা বাংলার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সময়টা মহাভারতের আমলে হোক, পাল কিংবা মোগল আমল অথবা ব্রিটিশ শাসনের সময়ে হোক — এই প্রশ্নটা একটা নির্ণায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে গিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই প্রশ্নটা অনেকদিন পর্যন্ত জীবন্ত অগ্নিগিরির মত এই জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে অবস্থান করবে।
ভারত উপমহাদেশ ইউরোপের মত একটি বিশাল ভূখণ্ড। এখানে অনেকগুলো জাতিসত্তা রয়েছে। একেকটি জাতিসত্তার পরিচয় অন্যটার চাইতে আলাদা। প্রথমে মোগল শাসন তারপর ব্রিটিশ শাসনের সময়ে একটি একলগ্ন শাসিত এলাকা হিসেবে দীর্ঘকাল একসঙ্গে অবস্থান করার কারণে এই অঞ্চলে যে আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রসত্তাটি বিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে উঠেছে সেটাকে জাতিরাষ্ট্র বলা ঠিক হবে না, অধিরাষ্ট্র বলাই সঙ্গত। ভারতীয় ইতিহাসের মূলদ্বন্দ্ব যেটা সেটা অধিরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জাতিসত্তাসমূহের সর্বাঙ্গীন মুক্তির মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সেই সম্ভাবনাটিকে ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোর সামনে মূর্ত করে তুলেছে। কেউ বলতে পারে না আগামী ইতিহাসে কি পরিমাণ পালাবদল, রূপান্তর ঘটবে, কি ধরনের ভাংচুর সংঘটিত হবে। কম্পাসের কাঁটার মত ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের দিকে যদি জাতির সকলের দৃষ্টি হেলে না থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে না।
ওপরে যে কথাগুলো বলা হল, সেগুলো রাষ্ট্রের গন্তব্য বা ডেস্টিনির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাষ্ট্র এবং জাতিকে অধিকাংশ সময়ে এক করে দেখা সঙ্গত নয়। রাষ্ট্রের টিকে থাকার যেমন কতগুলো চ্যালেঞ্জ থাকে [তেমন] কোন জাতির সুগঠিতভাবে বিকশিত হওয়ারও [পথেও] কতিপয় চ্যালেঞ্জ বর্তমান থাকে। আমার ধারণা বাংলাদেশি জাতির সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়ে ওঠার মুখে প্রধান বাধাটি হল ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে একটি সুষম সমন্বয়ের অভাব। বাংলাদেশি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে যদি ধর্মচিন্তাটি মুখ্য এবং প্রবল হয়ে দাঁড়ায়, [তবে] এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী উপজাতিসমূহ, সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান — এই সকল সম্প্রদায় জাতির মূল ধারাস্রোতের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব এবং পরিচিতি সন্ধান করতে ব্যর্থ হবে। আর যদি একমাত্র সংস্কৃতির চিন্তাটিকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ বেঁকে বসে উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যের বশে নিজেদের আকাক্সক্ষাটি অন্য সম্প্রদায়গুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠবে। ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে যথাযথ মেলবন্ধনটি যদি ঘটে যায় [তবে] জাতি সম্পর্কিত যে খণ্ডিত চিন্তাগুলো আমাদের জনগোষ্ঠীর নানা অংশে নানাভাবে ক্রিয়াশীল থাকে সেগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত সক্রিয় থাকলেও এক সময় অবসিত হতে বাধ্য।
আমার ধারণা, এই সময়ের প্রধান কর্তব্য হল আমাদের জাতির অন্তর্গত প্রতিটি ধর্ম এবং সম্প্রদায়, প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সকলকে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে একটি নতুন ইতিহাস প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে তার অংশীদার করে তোলা। এই জিনিসটি সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে কিংবা পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে অথবা মিষ্টিমধুর গালভরা বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়াস আন্তরিক এবং গভীর হতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেকদূর খনন করার পর সে মানসিক স্তরটি আবিষ্কার করতে হবে যেখানে আমরা আমাদের জাতির [অন্তর্গত] অন্য সম্প্রদায়, অন্য ধর্ম, অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে বিনাবাধায় মিশতে পারি, মিলতে পারি। অর্থাৎ আমরা কোথায় এক, সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সেটা আবিষ্কার করা।
বাংলাদেশের জাতি গঠনের প্রয়াসটি এই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে সেটা বোধ করি বলা সম্ভব নয়। কতগুলো বিব্রতকর প্রশ্ন কণ্টকের মত বাংলাদেশের সব মানুষ মিলে এক হওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অধিক বাক্যবিস্তার না করে আমি সরাসরি বলতে চাই, বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বাঙ্গালি না মুসলমান, [এই প্রশ্নের দুই পক্ষের মধ্যে] আমি তো কোন বিরোধ দেখি না। এই ব্যবধানটা মনগড়া, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশি পরিচয় যেমন আমাদের বাঙ্গালিত্বের পরিচয় খারিজ করে না। তেমনি আবার বাংলাদেশি পরিচয় অস্বীকার করেও বাঙ্গালিত্ব দাঁড়াতে পারে না। এগুলো একটা আরেকটার পরিপূরক বিষয়। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল এই গৌণ দিকসমূহকে মুখ্য করে দেখানো হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানীগুণী মানুষের বিরাট অংশ ঐক্যের পথ সন্ধান করার বদলে বিভেদের পথই সন্ধান করছেন। বিভেদের চিন্তা থেকে বিভেদই জন্ম নিতে বাধ্য।
যে শ্রেণীগুলো বাংলাদেশ শাসন করছে এবং ভবিষ্যতে শাসন করার সংকল্প ঘোষণা করছে তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে ঐক্যের কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে সেটা অনেকটা দুরাশার শামিল। তারা গোটা জাতির ওপর নিজেদের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। জাতির আত্মত্যাগ এবং স্বার্থত্যাগের ফসল আত্মসাৎ করে তারা নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করেছে। জাতির অধিকাংশ মানুষ অসহায় মাসুম বাচ্চার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরো একটি জাগরণ প্রয়োজন, প্রয়োজন আরো একটি যুদ্ধের যার মাধ্যমে গোটা জাতিকে তার আসল কক্ষপথটিতে স্থাপন করা সম্ভব হবে। য়
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন নরপতি শশাংকের সময়ে বাংলা অঞ্চলে যথার্থ অর্থে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শশাংক বাঙ্গালি ছিলেন [এমন] নিশ্চিত অকাট্য প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেননি। পাল সাম্রাজ্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল শাসকদের প্রায় চার শতাধিক বছরের শাসনের সময়ে এই বাংলা অঞ্চলে একটি জাতীয়তার উন্মেষ হয়েছিল সে ব্যাপারেও কোন স্থিরনিশ্চিত প্রমাণ নেই। এক সময়ে বৌদ্ধধর্ম একটা সর্বভারতীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাল রাজন্যবর্গের রাষ্ট্রচিন্তাতেও সর্বভারতীয় ধর্মচিন্তার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল নির্ণয় করা মুশকিল। আজকের দিনে ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ বাঙ্গালির জাতীয় রাষ্ট্রের পেছনের ভিত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাল রাজাদের সময়ের কথা উল্লেখ করে থাকেন। তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ঘটনার টানাপোড়েন, ইতিহাসের রাজ্য ভাঙ্গাগড়ার ঘটনা [আর] ওই ঐতিহাসিক অতীতকে নতুনভাবে বর্তমান জাতীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রকল্পটির মধ্যে প্রকৃত সত্যের পরিমাণ কতদূর [আর কতদূর] কল্পনা স্থিরনিশ্চিত হয়ে সে বিষয়ে কিছু বলার উপায় নেই।
ইতিহাস কোন খাপছাড়া ব্যাপার নয়। অতীতের পারম্পর্যসূত্র সঠিকভাবে অনুধাবন না করে বর্তমানের ঘটনার মূল্যায়ন করলে সেটি অযথার্থ হতে বাধ্য। উনিশশ একাত্তর সালে বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয় যে স্বাধীন রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছিল তার পেছনের ইতিহাস-পরম্পরা অদ্যাবধি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে সেটি সম্ভবও নয়। কোন বড় ঘটনা ঘটে গেলে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যা হোক, এখানে একটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রাষ্ট্রের গন্তব্য কোথায় এবং চ্যালেঞ্জসমূহ কি কি সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত সর্বসম্মত কোন মতামতও তৈরি হয়নি। বিতর্ক চলছে এবং অনেকদিন পর্যন্ত চলবে।
ইতিহাসের ঊষাকাল থেকেই বাংলা তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে গেলেও বেশির ভাগ সময়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব অগ্রাহ্য করা বাংলার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সময়টা মহাভারতের আমলে হোক, পাল কিংবা মোগল আমল অথবা ব্রিটিশ শাসনের সময়ে হোক — এই প্রশ্নটা একটা নির্ণায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে গিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই প্রশ্নটা অনেকদিন পর্যন্ত জীবন্ত অগ্নিগিরির মত এই জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে অবস্থান করবে।
ভারত উপমহাদেশ ইউরোপের মত একটি বিশাল ভূখণ্ড। এখানে অনেকগুলো জাতিসত্তা রয়েছে। একেকটি জাতিসত্তার পরিচয় অন্যটার চাইতে আলাদা। প্রথমে মোগল শাসন তারপর ব্রিটিশ শাসনের সময়ে একটি একলগ্ন শাসিত এলাকা হিসেবে দীর্ঘকাল একসঙ্গে অবস্থান করার কারণে এই অঞ্চলে যে আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রসত্তাটি বিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে উঠেছে সেটাকে জাতিরাষ্ট্র বলা ঠিক হবে না, অধিরাষ্ট্র বলাই সঙ্গত। ভারতীয় ইতিহাসের মূলদ্বন্দ্ব যেটা সেটা অধিরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জাতিসত্তাসমূহের সর্বাঙ্গীন মুক্তির মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সেই সম্ভাবনাটিকে ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোর সামনে মূর্ত করে তুলেছে। কেউ বলতে পারে না আগামী ইতিহাসে কি পরিমাণ পালাবদল, রূপান্তর ঘটবে, কি ধরনের ভাংচুর সংঘটিত হবে। কম্পাসের কাঁটার মত ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের দিকে যদি জাতির সকলের দৃষ্টি হেলে না থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে না।
ওপরে যে কথাগুলো বলা হল, সেগুলো রাষ্ট্রের গন্তব্য বা ডেস্টিনির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাষ্ট্র এবং জাতিকে অধিকাংশ সময়ে এক করে দেখা সঙ্গত নয়। রাষ্ট্রের টিকে থাকার যেমন কতগুলো চ্যালেঞ্জ থাকে [তেমন] কোন জাতির সুগঠিতভাবে বিকশিত হওয়ারও [পথেও] কতিপয় চ্যালেঞ্জ বর্তমান থাকে। আমার ধারণা বাংলাদেশি জাতির সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়ে ওঠার মুখে প্রধান বাধাটি হল ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে একটি সুষম সমন্বয়ের অভাব। বাংলাদেশি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে যদি ধর্মচিন্তাটি মুখ্য এবং প্রবল হয়ে দাঁড়ায়, [তবে] এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী উপজাতিসমূহ, সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান — এই সকল সম্প্রদায় জাতির মূল ধারাস্রোতের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব এবং পরিচিতি সন্ধান করতে ব্যর্থ হবে। আর যদি একমাত্র সংস্কৃতির চিন্তাটিকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ বেঁকে বসে উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যের বশে নিজেদের আকাক্সক্ষাটি অন্য সম্প্রদায়গুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠবে। ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে যথাযথ মেলবন্ধনটি যদি ঘটে যায় [তবে] জাতি সম্পর্কিত যে খণ্ডিত চিন্তাগুলো আমাদের জনগোষ্ঠীর নানা অংশে নানাভাবে ক্রিয়াশীল থাকে সেগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত সক্রিয় থাকলেও এক সময় অবসিত হতে বাধ্য।
আমার ধারণা, এই সময়ের প্রধান কর্তব্য হল আমাদের জাতির অন্তর্গত প্রতিটি ধর্ম এবং সম্প্রদায়, প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে সকলকে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে একটি নতুন ইতিহাস প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে তার অংশীদার করে তোলা। এই জিনিসটি সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে কিংবা পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে অথবা মিষ্টিমধুর গালভরা বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রয়াস আন্তরিক এবং গভীর হতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেকদূর খনন করার পর সে মানসিক স্তরটি আবিষ্কার করতে হবে যেখানে আমরা আমাদের জাতির [অন্তর্গত] অন্য সম্প্রদায়, অন্য ধর্ম, অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে বিনাবাধায় মিশতে পারি, মিলতে পারি। অর্থাৎ আমরা কোথায় এক, সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সেটা আবিষ্কার করা।
বাংলাদেশের জাতি গঠনের প্রয়াসটি এই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে সেটা বোধ করি বলা সম্ভব নয়। কতগুলো বিব্রতকর প্রশ্ন কণ্টকের মত বাংলাদেশের সব মানুষ মিলে এক হওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে থেকে যাচ্ছে। অধিক বাক্যবিস্তার না করে আমি সরাসরি বলতে চাই, বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বাঙ্গালি না মুসলমান, [এই প্রশ্নের দুই পক্ষের মধ্যে] আমি তো কোন বিরোধ দেখি না। এই ব্যবধানটা মনগড়া, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশি পরিচয় যেমন আমাদের বাঙ্গালিত্বের পরিচয় খারিজ করে না। তেমনি আবার বাংলাদেশি পরিচয় অস্বীকার করেও বাঙ্গালিত্ব দাঁড়াতে পারে না। এগুলো একটা আরেকটার পরিপূরক বিষয়। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল এই গৌণ দিকসমূহকে মুখ্য করে দেখানো হচ্ছে। আমাদের জ্ঞানীগুণী মানুষের বিরাট অংশ ঐক্যের পথ সন্ধান করার বদলে বিভেদের পথই সন্ধান করছেন। বিভেদের চিন্তা থেকে বিভেদই জন্ম নিতে বাধ্য।
যে শ্রেণীগুলো বাংলাদেশ শাসন করছে এবং ভবিষ্যতে শাসন করার সংকল্প ঘোষণা করছে তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে ঐক্যের কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে সেটা অনেকটা দুরাশার শামিল। তারা গোটা জাতির ওপর নিজেদের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। জাতির আত্মত্যাগ এবং স্বার্থত্যাগের ফসল আত্মসাৎ করে তারা নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করেছে। জাতির অধিকাংশ মানুষ অসহায় মাসুম বাচ্চার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরো একটি জাগরণ প্রয়োজন, প্রয়োজন আরো একটি যুদ্ধের যার মাধ্যমে গোটা জাতিকে তার আসল কক্ষপথটিতে স্থাপন করা সম্ভব হবে।
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮
পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, শাহবাগ আন্দোলন বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪