আজকের কাগজের পাঠক-পাঠিকার স্মরণ থাকতে পারে প্রায় মাসছয়েক আগে এ কাগজে আমি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে একটি লেখা লিখেছিলাম। ওই রচনাটিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে পারমাণবিক বস্তুর তুলনা করেছিলাম। পারমাণবিক বর্জ্য এমন এক জিনিস তাঁর তেজষ্ক্রিয়া কেয়ামতের দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত এমন কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেন নি যা পারমাণবিক বর্জ্যরে তেজষ্ক্রিয়তা হরণ করতে পারে।
আমি সামান্য কলাম-লেখক। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্যতা এবং ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। তথাপি এরশাদের ওপর লেখাটি আমি অন্তরাবেগের তাগিদে লিখে ফেলতে পেরেছিলাম। আমার কথাগুলো যদি মিথ্যা প্রমাণিত হত আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। এখন দেখতে পাচ্ছি আমার কথাগুলো সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। এই বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি বিষাদাচ্ছন্ন করেছে।
সকলেই জানেন, এরশাদ একজন মহাটাউট মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে এবং রাজনৈতিক জীবনে এমন কোন গর্হিত অপরাধ নেই যা এরশাদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি। এরশাদ সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা জবরদখল করেছেন। দীর্ঘদিন একনায়কতন্ত্র কায়েম রেখেছেন। শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে নারীঘটিত ব্যাপার পর্যন্ত সবকিছুতে কেলেঙ্কারির প্রমাণ রেখেছেন। এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে বাংলাদেশকে গোটা নব্বই দশকের অধিকাংশ সময় রাজপথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে। শহীদ নূর হোসেন থেকে শুরু করে অনেক মানুষকে প্রাণবিসর্জন দিতে হয়েছে। রাজপথে অনেক রক্ত ঝরেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ত্যাগ করে এরশাদকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।
এরশাদকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়ার পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সরকারের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এরশাদকে নানারকম দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত করে কারাগারে পাঠান এবং তাঁর বিচারের ব্যবস্থা করেন। বিচারে এরশাদকে দণ্ডিত ঘোষণা করা হয়। এরশাদের কারাদণ্ডের মেয়াদ ফুরোবার আগেই আবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার মধ্যে কে ক্ষমতায় যাবেন সে ব্যাপারটি নির্বাচনের অব্যবহিত পরে অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়। কারণ জয়ী আওয়ামী লীগ এবং পরাজিত বিএনপি উভয়ের মধ্যে আসনসংখ্যার ফারাক ছিল খুবই অল্প। এরশাদের দল যে পক্ষকে সমর্থন দেবে তাদেরই সরকার গঠন করার কথা। বাজারে জনরব আছে বেগম জিয়া এরশাদের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি যদি বিএনপিকে সমর্থন দেন এবং ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেন তাহলে তাঁকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। এরশাদ খালেদা জিয়াকে সমর্থন দেননি। সরকার গঠনে শেখ হাসিনাকেই সহায়তা করেছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ হাসিনা এরশাদকে কারাগার থেকে মুক্তিদান করেছিলেন।
হাসিনার শাসনকালের তিন বছর অতীত না হতেই এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতপার্থক্য প্রবল হতে থাকে। এক পর্যায়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেন। প্রায় এক বছরের অধিক সময় পর্যন্ত দেশের নানা জায়গায় সশরীরে শরীকদলের নেতাদের সঙ্গে হাজির থেকে এরশাদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে কুণ্ঠিত হননি যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে না পারলে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না। বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এরশাদ চারদলের সঙ্গে জোট তৈরি করতে বাধ্য হয়েছেন।
তারপরের কাহিনী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলাটি আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় জীবিত করে এরশাদকে কারারুদ্ধ করে। বিচারে এরশাদের পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হয়। যেহেতু তিনি বিচারের আগে বেশকিছু দিন কারাগারে ছিলেন তাই তাঁর কারাবাসের মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়। যা হোক, অল্প কিছুদিন আগে এরশাদের পক্ষ থেকে জরিমানার টাকা পরিশোধ করা হয়। জরিমানার টাকা পরিশোধ করা সত্ত্বেও এরশাদের [পক্ষে] জেল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক নতুন মামলা দায়ের করেছে। এ মামলার আসামি হিসেবে বন্দী থাকার সময় এরশাদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের তরফ থেকে আলাপ আলোচনা করার জন্যে আমাদের প্রতিবেশী দেশের এক কূটনীতিক — মধ্যপ্রাচ্যের আরেক কূটনীতিককে সঙ্গে নিয়ে — কারাগারে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কারাগারে এ সাক্ষাতের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকার এ ঘটনাটিকে স্বীকার করে নেয়নি।
কিন্তু তারপরও [কথা আছে।] এই সাক্ষাতকারের প্রতিক্রিয়ার দরুন জেলখানায় এরশাদের অসুখ বেড়ে যায়। তাঁর হৃৎপিণ্ডের গতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং [তিনি] চোখে কম দেখতে আরম্ভ করেন। হাসিনা সরকারকে পাছে এরশাদের অকালমৃত্যুর জন্যে দায়ী হতে হয় সে আশঙ্কায় [তাঁকে] জেলখানা থেকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালের প্রিজন সেলে স্থানান্তর করে তড়িঘড়ি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়।
সরকারের সময়োচিত সুচিকিৎসার উদ্যোগ গ্রহণ করার সুফল যে ইতিমধ্যে ঘটতে আরম্ভ করেছে তা দেশের সকল মানুষ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। এরশাদের আরোগ্যলাভের লক্ষণগুলো ইতিমধ্যে দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। প্রিজন সেলে তিনি জাতীয় পার্টির উনচল্লিশ জন নেতা ও কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং তাদের পরবর্তী কর্মপন্থা কি হতে পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছেন। তাছাড়া এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ এবং ভ্রাতা জিএম কাদের সব সময় দেখা-সাক্ষাত করছেন। ডাক্তারদের মতে এরশাদের দৃশ্যত কোন অসুখ নেই। [তবে] তাঁর চোখের অসুখ এখনো পুরোপুরি সারেনি। জেল থেকে যেদিন মুক্তি পাবেন তাঁর চোখ দু’টো সেদিন সেরে উঠবে।
এরশাদের আরোগ্যলাভের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যেও একটা মস্ত বড় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। চারদলীয় ঐক্যজোট কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এরশাদের দলের এমপিরা লাঙ্গল প্রতীক রক্ষার দোহাই দিয়ে সংসদ অধিবেশনে হাজিরা দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি আবার দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। পার্টির প্রেসিডেন্ট এরশাদ একদিকে এবং নাজিউর রহমান মঞ্জুর অন্যদিকে। এ ভাঙ্গনের মধ্যেও কোনরকম পাতানো খেলার ব্যাপার আছে কিনা কারো আগাম বলার উপায় নেই। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নীতিহীনতা এবং চরিত্রহীনতার প্রকোপ এত অধিক যে ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়োজনে যে কোন দল যে কোন দলের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলতে পারে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের গরমিল যতই থাকুক না কেন [তা] কোনরকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না।
এরশাদ আবার বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তমানব হিসেবে দেখা দেবেন। সেটা আর অনুমান এবং কল্পনার বিষয় নয়। যে কোন দিন শাহবাগের হাসপাতাল থেকে গুলশানের বসত বাড়িতে বীরদর্পে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ফেরত যেতে পারেন তিনি। এরশাদের মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পার্টির সামনে আরো একটা সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। মিজান-মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন যে অংশটি এতকাল এরশাদকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে তারাও আবার এরশাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিয়ে শক্তিবৃদ্ধি করবেন সেটা একটুও অমূলক নয়। আরেকটা কথা চালু আছে। রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নেই। কিন্তু শেষকথার আলামত হিসেবে চরিত্রহীনতা, নীতিহীনতা এবং রাজনৈতিক ভোজবাজির যে চিত্রগুলো একটার পর একটা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে তা থেকে এটা অনুমান করা কষ্টকর নয় যে আগামীতে আমরা একটি প্রচণ্ড জাতীয় সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি।
বিগত ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ প্যারেড ময়দানে যে উত্তপ্ত ভাষণটি দিয়েছেন তার মধ্যে দেশের বিবদমান বড় দল দু’টির মধ্যে আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে শান্তি এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কোন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং বলা যেতে পারে সংঘাতের সম্ভাবনা তিনি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাদের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী সভাসমিতি এবং জনসমাবেশে প্রধান বিরোধী দল এবং তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশে যে ধরনের অশালীন এবং অশোভন উক্তি করেছেন তার মধ্যে রাজনৈতিক সুস্থতা এবং সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে এ পর্যন্ত দশ/বারোটা ডক্টরেট ডিগ্রি আদায় করেছেন। এতগুলো ডক্টরেট ডিগ্রি যাঁর জিহ্বার উচ্চারণে শালীনতা সঞ্চার করতে পারেনি তাঁর কাছ থেকে কোনরকম যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য এবং উচ্চারণের প্রত্যাশা অনেকটা দুরাশার নামান্তর।
প্রধানমন্ত্রীর এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং দাম্ভিক কথাবার্তা শুনে দেশের চক্ষুমান মানুষদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এ অসহায়ত্বের অনুভূতিটি যতটুকু সম্ভব পত্রপত্রিকায় প্রকাশও করে যাচ্ছেন সীমিত আকারে। কারণ দেশের অধিকাংশ জনপ্রিয় এবং চালু পত্রিকা সরকারি দলের সমর্থক। তারা সরকার বেকায়দায় পড়বে এমন কোন মতামত এবং মন্তব্য প্রকাশ করতে সাধারণত কুণ্ঠিত থাকেন। কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। সরকারি দল এবং সরকারপ্রধানের সার্বক্ষণিক তোয়াজ করা এক কথা, দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মূলকথা হল লড়াইরত দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু প্রতিহিংসা থাকবে না। প্রতিযোগিতার মধ্যে নিয়মকানুন এবং নীতিবোধ সক্রিয় থাকে [কিন্তু] প্রতিহিংসা নিয়মনীতি কিছুই মানে না। মারি অরি পারি যে কৌশলে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে সরকার এ প্রতিহিংসার ইন্ধনই যুগিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক আজকের কাগজ
পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ৩৬, ৮