ফাদার টিম এবং ফরহাদ মজহার

আজ হইতে পুরা দুই যুগ মানে গোটা ২৪ বছর আগে মহাত্মা আহমদ ছফা এই লেখাটি সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। যতদূর জানা যায় লেখাটি এখনো তাঁহার কোন গ্রন্থের মধ্যে লওয়া হয় নাই।

এই লেখায় তিনি যে শঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহা প্রায় ষোল আনাই ফলিয়া গিয়াছে। ২৪ বছর কম সময় নহে। ১৯৪৭ হইতে ১৯৭১ যতটুকু সময়, ১৯৮৯ হইতে ২০১৩ ঠিক ততটুকু সময় বটে। তবে এই সময়ের পরিসরে বাংলাদেশের সমাজ গঠনে কোন অপূর্ব পরিবর্তন ঘটে নাই। যদি কিছু ঘটিয়াই থাকে তাহাতে কিন্তু প্রমাণ হয় নাই বাংলাদেশ পৃথিবীর বাহিরের দেশ। নেপচুন কিংবা মঙ্গলগ্রহে তাহার অবস্থান নহে।

সত্যের মধ্যে বাংলাদেশে গত ২৪ বছরে আরো বিশ্বযোগ ঘটিয়াছে। ঘটিয়াছে দেশে এনজিও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধিও। ইতিমধ্যে আহমদ ছফার মহাবিয়োগ ঘটিলেও যতদূর জানা যায় ফাদার টিম আজও আমাদের মধ্যে বাঁচিয়া আছেন। ফরহাদ মজহার তো দিব্য তবিয়তেই বহাল আছেন।

এই লেখাটি আমরা ‘খবরের কাগজ’ হইতে হুবহু পুনর্মুদ্রণ করিতেছি। সম্পাদনার মধ্যে কিছু ছাপার ভুল সংশোধন করা হইয়াছে মাত্র। যেমন ‘ফরহাদ মজহার’ নামটি আদপে ছাপা হইয়াছিল ‘ফরহাদ মযহার’। আর একটি কথা। পড়িবার সুবিধার জন্য আমরা লেখাটিতে তিনটি পর্ববিভাগ করিয়া দিয়াছি। লেখাটি সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেন সৈয়দ আনোয়ার করিম। আর লেখাটি ‘সর্বজন’ সমীপে পাঠাইয়াছেন সৈয়দ মনজুর মোরশেদ। উভয়ের সাকিন সৈয়দবাড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম। আমরা তাঁহাদের ঋণ স্বীকার করিতেছি। এই ঋণ পরিশোধ করার অতীত।

 

বেশ কিছুদিন থেকে এনজিওর পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন এনজিওরা দেশের ভালো করছে আবার অনেকে বলছেন, না দেশের উন্নয়নে এনজিওর ভূমিকা ঋণাত্মক। এই ব্যাপারে আমি আমাদের পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এর পর পর দুটি সংখ্যায় একটি দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম। ঐ লেখায় বলেছিলাম যে এনজিও আমাদের দেশের তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি সাম্প্রতিক ব্যাপার। অতীতে এনজিও জাতীয় কোন কিছু ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীর সর্বাঙ্গীন বিকাশের এই পরিস্থিতিতে এনজিওর উদ্ভব হয়েছে।

সে যা হোক এনজিও আমাদের জাতীয় জীবনে একটা উল্লেখ্য স্থান দখল করে বসেছে। ঐ রচনায় দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম আমাদের দেশে এনজিওগুলো যে পদ্ধতিতে কাজকর্ম পরিচালনা করে তা সমাজের বিশেষ মঙ্গল বয়ে আনছে না। অন্যদিকে নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে। পরে আমি আনন্দিত হয়ে লক্ষ্য করেছি সরকার এনজিওর কর্মকাণ্ডের উপর কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। পরে আরো জেনেছি সাভারস্থ বিপিএটিসি ইনস্টিটিউটে বিসিএস ক্যাডারদের আমার ঐ লেখাটা পড়ানো হচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে ফাদার টিম এবং জনাব ফরহাদ মজহার এনজিওর কাজকর্মের তারিফ করে দুটো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ফরহাদ মজহার সাহেবের সাক্ষাৎকারটির বিষয়ে পরে কিছু বলবো। শুরুতে আমি ফাদার টিমের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

ফাদার টিম তাঁর সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন সারসংক্ষেপ করলে [তা] এরকম দাঁড়াবে। এনজিওগুলো গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণসাধন করছে। এনজিও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনেক গরিব মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কখনো এই গরিব মানুষদের অসহনীয় অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করেনি। এনজিওরা এগিয়ে এসে তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে এবং অনেক কিছু ভালো কাজ করছে। সুতরাং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এনজিও অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

ফাদার টিম একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী। আমাদের দেশের দরিদ্র জনগণের মঙ্গলের জন্য তিনি যে শ্রম, নিষ্ঠা এবং উদ্যোগ অতীতে ব্যয় করেছেন এবং বর্তমানেও করছেন তা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ জিনিশ। আমি তাঁকে ছোট করতে চাইবো না। তাঁর উপর শ্রদ্ধা রেখে বিনীতভাবে একটি ছোট প্রশ্ন করতে চাই। এনজিওগুলো কি কখনো রাজনৈতিক পার্টির ভূমিকা পালন করতে পারবে? রাজনৈতিক দলগুলোর হ্রস্ব দৃষ্টির যে সমালোচনা [তিনি] করেছেন [তা] কবুল করতে আপত্তি নেই। কিন্তু রাজনৈতিক পার্টির প্রয়োজনীয়তা কি তিনি অস্বীকার করতে পারেন?

আরো একটি প্রশ্ন। এনজিওর মাধ্যমে বিকল্প উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব? জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ মানুষ যদি ভূমিহীন হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের সমাজের মোট কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৭ কোটির মতো। বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে যত এনজিও কর্মরত আছে তাদের মাধ্যমে যত লোক উপকৃত হচ্ছে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে ধরলেও আনুমানিক (কর্মচারীসহ) ৬-৭ লাখ। ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৬-৭ লাখ মানুষ নিয়ে এনজিওগুলো ব্যস্ত রয়েছে। বাকি মানুষগুলো যাবে কোথায় এবং তাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে?

ফাদার টিম আরো অনেক কথা বলেছেন। আমরা সেসব উত্থাপন করতে যাচ্ছি না। এখন জনাব ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকারটির বিষয়ে কিছু বলি।

ফরহাদ সাহেব এনজিওর একটা তাত্ত্বিক ছদ্ম প্রগতিশীল ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন এনজিওগুলো প্রাক-ধনতান্ত্রিক যে সম্পর্ক সমাজে এখনো টিকে আছে তার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এটা একটা বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা। আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক না সামন্ততান্ত্রিক, না আধা-সামন্ততান্ত্রিক — এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অতীতে বিস্তর বাদানুবাদ হয়েছে। আমরা সে সবের মধ্যে প্রবেশ করতে চাই না। এনজিওকে হালাল করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের একটা খোঁড়া যুক্তির অবতারণা না করলেও পারতেন ফরহাদ সাহেব। এটা এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতারণা। তিনি যে কর্মটি করছেন সামাজিকভাবে যুক্তিসিদ্ধ দেখানোর উদ্দেশ্যে তিনি এ কৌশলটির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।

তারপর তিনি বলেছেন, এনজিও দুই রকমের। একধরনের এনজিও পাশ্চাত্যের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করছে। অন্য এনজিওগুলো বাংলাদেশে একটা সমাজ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট নির্মাণের পথ প্রশস্ত করছে। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি কার্ল মার্কসের নামও উল্লেখ করেছেন। আমি যদি তাঁর কথা যথাযথ বুঝে থাকি তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে এরকম। বাংলাদেশে কিছু কিছু মার্কসবাদী এনজিও রয়েছে যারা অদূর ভবিষ্যতে একটি বিপ্লবী রাজনীতি নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। ফরহাদ সাহেব এই কথাগুলো বললেন কি কারণে তা বুঝতে পারলাম না।

এই দেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা এবং ভ্রান্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। তারপরেও একটা কথা সত্য যে ঐ ভ্রান্তি এবং ঐ ব্যর্থতা থেকেই উত্তরণের পথ বেরিয়ে আসবে। যদি না আসে এদেশের এই জনগোষ্ঠীর কোন ভবিষ্যৎ নেই। এই দেশে বিপ্লবী রাজনীতির (নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও) যতটুকু বিকাশ হয়েছে তা এই সমাজ বাস্তবতার ভেতর থেকেই হয়েছে। বিপ্লবী রাজনীতির যে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা তা আত্মসাৎ করেই নতুন বিপ্লবী সংগঠন জন্ম নিতে পারে। একটা জনগোষ্ঠী সফল হোক ব্যর্থ হোক [তাদের] বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতা নেগেট করে কোন বিপ্লবী আন্দোলন জন্ম নিতে পারে না। কিন্তু ফরহাদ মজহার সাহেবের বক্তব্য শুনে মনে হয় যে এদেশের একশ্রেণীর এনজিও আগামী কোন এক প্রত্যুষে বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। তাঁর এই বক্তব্যের বাস্তব সম্ভাবনা কতদূর? তাত্ত্বিক বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। যে সমস্ত দেশ অর্থকড়ি দিয়ে এই ফরহাদ কথিত মার্কসবাদী এনজিওগুলো চালু রেখেছে তারা কি চাইবে যে এদেশে একটি বিপ্লব ঘটুক?

ফরহাদ মজহার সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। তাঁর বাকচাতুরি এবং নানাবিধ গুণ ও পারমঙ্গতার বিষয়ে আমরা বিলক্ষণ অবগত আছি। চটকদার বাক্য উচ্চারণ করে তিনি বেশিদূর যেতে পারবেন না। নিজে বিভ্রান্ত হবেন এবং অন্যদের বিভ্রান্তিতে ফেলবেন। আমার তো শংকা হয় ইতিমধ্যে তিনি একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবার কারখানা খুলে বসেছেন। ফরহাদ সাহেব আত্মপ্রসাদ অনুভব করার জন্য যদি এসব কথাবার্তা বলে থাকেন আমাদের বলার কিছু থাকবে না। এমন কি বারাঙ্গনারাও আপন আপন পেশাকে সম্মানজনক মনে করে।

এদেশে অনেকে এনজিও করছে। ফরহাদ সাহেবের প্রয়োজন আছে, তিনিও করছেন। এই সরল সত্য সরলভাবে প্রকাশ করলে ভালো হতো। তা না করে বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদ এসব জড়িত করে একটা জগাখিচুড়ি বক্তব্য রেখে [তিনি] নিজে মুশকিলে পড়লেন এবং অন্যদেরও মুশকিলে ফেললেন। এতে ফরহাদ সাহেবের প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছে বটে কিন্তু এক বিন্দু নৈতিক সততার প্রমাণ মেলেনি।

এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সাম্প্রতিককালের সমাজ বিপ্লবে নতুন নতুন পন্থা এবং সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। সমাজ বিপ্লবের সনাতন মার্কসীয় ধ্যানধারণার মধ্যে নানা ভাংচুর চলছে। নানা খোঁজখবর করতে চেষ্টা করেছি। এ সমস্ত দেশগুলোর কোথাও [কেউ] সমাজ বিপ্লবের সংগে এনজিও ধ্যান-ধারণার মিলন ঘটাতে পেরেছে সে রকম কোন সংবাদ তো পাইনি।

ফরহাদ সাহেব বিপ্লবের এরকম একটি মৌলিক তত্ত্ব দাঁড় করাতে পেরেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি শুভ সংবাদ। আমরা তাঁকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত বিপ্লবের অন্যান্য তাত্ত্বিক প্রথিতযশা মনীষীর পাশে ফরহাদের একটা স্থান থাকবে। অথবা বলতে হবে বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরের একটি দেশ। নেপচুন কিম্বা মঙ্গলগ্রহে তার অবস্থান!

ফরহাদ সাহেব নানা সময় নানা কথা বলে থাকেন এবং নানান কাজ করে থাকেন। অনেক সময় তাঁর কাজকর্মের মধ্যে সংগতি খোঁজার চেষ্টা করলে চেষ্টাই সার হয়। কোন ফল মেলে না। কখনো তিনি কবি, কখনো বিপ্লবী, কখনো এনজিও মালিক, কখনো রাজনৈতিক নেতা, কখনো বা মার্কিন প্রবাসী বাঙালী ভদ্রলোক। এই এতগুলো পরিচয়ের মধ্যে কোন পরিচয়ে তাঁকে আমরা চিনে নেবো? একই অংগে এত রূপ! এত বৈচিত্রের মধ্যে কোন বিন্দুটিতে আমরা একটা সামগ্রিক ঐক্য খুঁজে পাবো?

আমার তো মনে হয় ফরহাদ সাহেব হয়তো অতিমানব নয়তো রঙিন কুয়াশা যা দৃষ্টিকে ক্রমাগত প্রতারিত করে। আল্লাহ না করুন এই শেষের পরিচয়টি যদি সত্য প্রমাণিত হয় ভীষণভাবে ব্যথিত হবো।

 

প্রথম প্রকাশ: খবরের কাগজ, বর্ষ ৮ সংখ্যা ৩৮, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, ৬ আশ্বিন ১৩৯৬
পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ২৬, ২০ সেপ্টেম্বর

১ Comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।