বাঙ্গালি মুসলমানের মন (মূল পাঠ ১৯৭৬) — ১

‘শহীদে কারবালা’ পুঁথিতে কবি কারবালার যুদ্ধে শহীদ হজরতের দৌাহিত্র হজরত হোসেনের মস্তকসহ ঘাতক সীমারের দামেস্ক যাত্রা অংশটি রচনা করতে গিয়ে তাঁর কল্পনাশক্তির অবাধ ব্যবহার করেছেন। কবি বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন: কারবালা থেকে দামেস্ক যাচ্ছে সীমার, মনে অপার আনন্দ, এখন হজরত হোসেন বিগতজীবন, কাঁধের বর্শার অগ্রভাগে শোভা পাচ্ছে তাঁর কর্তিত মস্তক। লক্ষ টাকা পারিতোষিক লাভ করার পথের যাবতীয় প্রতিবন্ধক অন্তর্হিত। নিশ্চয়ই বাদশাহ নামদার এজিদ তাঁর প্রতিশ্র“তি পালন করবেন। যেতে যেতে সন্ধ্যা হল পথে। সে রাতের জন্য সীমারকে এক গৃহস্থের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হল। গৃহকর্তার নাম—পুঁথিলেখকের জবানিতে—আজর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তার উপর আবার ব্রাহ্মণ। সেই রাতে হজরত হোসেনের ছিন্নমস্তক এক অলৌকিক কাজ করে ফেলল। গৃহকর্তা আজর, তার ব্রাহ্মণী, সাত পুত্র এবং সাত পুত্রবধূ একসঙ্গে কাটা মস্তকের মুখে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল।

পুঁথিপুরাণের জগতে এরকম অলৌকিক কাণ্ড প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। ওই জাতীয় সাহিত্যের বেশির ভাগেরই একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল ধর্মের মহিমা কীর্তন করা। সেজন্য পুঁথিপুরাণের নায়কদের চরিত্রে সম্ভব অসম্ভব সব রকমের ক্ষমতা এবং গুণগ্রাম আরোপ করাটাই বিধি। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক প্রোপাগান্ডা লিটারেচারের সঙ্গে পুঁথিসাহিত্যের একটি সমধর্মিতা আবিষ্কার করা খুব দুরূহ কর্ম নয়। শুধু পুঁথিসাহিত্য কেন, ‘বৌদ্ধ জাতক’ থেকে শুরু করে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ এবং মঙ্গলকাব্যসমূহেরও উদ্দেশ্য ছিল ঐ একই রকম। ওই জাতীয় সাহিত্যে সচরাচর যে [সকল] অবাস্তব অলৌকিক কাণ্ড ঘটে থাকে [পুঁথি] ঘেঁটে [তার] একটা তালিকা সংগ্রহ করলে ছিন্নমস্তকের মুখে কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাটা খুব আশ্চর্য ঠেকবে না। পুঁথিপুরাণ রচয়িতাদের পাল্লায় পড়ে বনের হিংস্র বাঘ, শিঙ্গওয়ালা হরিণ পর্যন্ত মানুষের ভাষায় কথা বলে, দুঃখে রোদন করে, কাটা মাথা তো কোন ছার! সুতরাং ধরে নেয়া ভাল, পুঁথিপুরাণের জগতে জাগতিক নিয়মের পরোয়া না করে লোমহর্ষক ঘটনারাজি একের পর এক অবলীলায় ঘটে যেতে থাকে। রোমাঞ্চকর হিন্দি ছবির দর্শকের মত পাঠকের রুদ্ধশ্বাসে দেখে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সম্ভব অসম্ভব, বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। যেমন:

লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার
গণিয়া দেখিল মর্দ চল্লিশ হাজার।

এ জাতীয় পংক্তি পাঠ করার পরেও বুদ্ধিমান সিরিয়াস মানুষের মনে কোন জিজ্ঞাসাচিহ্ন জাগে না অর্থাৎ সকলে ধরে নিয়ে থাকেন, পুঁথিপুরাণের জগতে এ জাতীয় ঘটনা হামেশা ঘটতেই থাকবে। এ নিয়ে মনকে কষ্ট দেওয়া খামোখা পণ্ডশ্রম। কাণ্ডজ্ঞান ফাঁকি দেয়া এ জাতীয় এন্তার ঘটনা সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হতে হবে। সে ব্যাপারে আগাগোড়া প্রস্তুতি গ্রহণ করেই পুঁথিপুরাণের জগতে প্রবেশ করা উত্তম।

এরকম অভিজ্ঞতা বোধ করি অনেকেরই হয়ে থাকে। রাশি রাশি ঘটনার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনার অতি সামান্য খণ্ডাংশ মুহূর্তেই ধাক্কা দিয়ে পাঠককে সচকিত করে তোলে। ‘শহীদে কারবালা’য় বর্ণিত এই ঘটনাটিও সেই জাতীয় একটি। সীমার কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে আজর নামধারী জনৈক ব্রাহ্মণের দেখা পেয়েছিল এবং তার বাড়িতে রাতের আতিথ্য গ্রহণ করেছিল। এই অংশটি পাঠ করার পরেও মনের ভেতরে একটি ঘোরতর অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই সাধারণ একান্ত বাস্তব ঘটনাটিকে পাঠকের মনের জারক রস হজম করে নিতে পারে না। মনের তলাতে শিলাখণ্ডের মত তা পড়ে থাকে। তিনি যদি তার বদলে ইরানি, তুরানি, ইহুদি, খ্রিস্টান, তাতার, তুর্কি ইত্যাদি যে কোন জাতির, যে কোন ধর্মের মানুষের সঙ্গে সীমারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতেন পাঠকের মনে কোন প্রশ্নই জাগত না। কিন্তু তিনি কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে ধুধু মরুপ্রান্তরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণকে আমদানি করলেন কোত্থেকে! একজন ব্রাহ্মণ কারবালা দামেস্কের মাঝপথে দারাপুত্রপরিবার নিয়ে কাটা মস্তকের কাছে কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য বসবাস করছিল। এইখানে মন ভয়ঙ্কর রকম বেঁকে বসে।

শুধু ‘শহীদে কারবালা’ নয় ‘জঙ্গনামা’ পুঁথিটার উপর দৃষ্টি বুলালেও এই রকম অজস্র ঘটনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘জঙ্গনামা’তে পুঁথিলেখক হজরত আলিকে দিয়ে কাফের ও বেদীনদের উপর এমন চোটপাট চালিয়েছেন যে গদার আঘাতে থেতলানো, তলোয়ারের ঘায়ে কাটা পড়া কিংবা শেষ পর্যন্ত পবিত্র ধর্ম ইসলামের শরণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত কারো রক্ষা নাই। আমির হামজার শৌর্যবীর্য অবলম্বন করে পুঁথি রচিত হয়েছে। পড়লে লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মত অনেক চমৎকার সংবাদ পাওয়া যায়। প্রায়শ দেখানো হয়েছে, মহাবীর হামজা এমন শক্তিশালী যে তিনি দেশদেশান্তর ঘুরে ঘুরে কাফেরদের সদলবলে পরাস্ত করছেন আর তাদের ঘরের সুন্দরী নারীদের পাণিপীড়ন করে চলেছেন তো চলেছেনই। পুঁথিলেখকের কাছে কাফের এবং হিন্দু অনেকটা সমার্থক। [তাঁরা] অনেক সময় কাফের বলতে হিন্দু এবং হিন্দু বলতে কাফের ধরে নিয়েছেন।

সে যা হোক, আমির হামজা এমন মস্তবড় বীর যে তিনি দৈত্যের দেশ কো-কাফে গমন করে অপার শৌর্যবলে দৈত্যদের দমন করে বীরবিক্রমে ফিরে এসেছেন। হযরত আলির কল্পিত পুত্র মোহাম্মদ হানিফার বীরত্বগাথা বর্ণনা করে ‘সোনাভান’, ‘জৈগুনবিবি’ ইত্যাদি যেসব পুঁথি লেখা হয়েছে বিষয়বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে সেগুলো আরো মজার। সে সকল পুঁথিতে দেখা যায় যে মোহাম্মদ হানিফা ‘দুলদুল’ ঘোড়ায় চড়ে দুইধারী তলোয়ার ঘুরিয়ে দেশ থেকে দেশে নব অশ্বমেধযজ্ঞ করে বেড়াচ্ছেন। পথে যেসব রাজ্য পড়ছে সবগুলো নারীশাসিত। এই নারীদের সকলেই সুন্দরী সদব্রাহ্মণ কন্যা, অবিবাহিতা এবং প্রচণ্ড রকমের বীরাঙ্গনা। আর সকলের এমন এক ধনুকভাঙ্গা পণ যে বাহুবলে যে পুরুষ হারাতে পারবে তাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে বিয়ে বসতে মোটেই রাজি নয়। মোহাম্মদ হানিফা সংবাদ শুনে হাওয়ার বেগে সে দেশে দেখা দিচ্ছেন, রণংদেহি হুংকার তুলছেন। বীরাঙ্গনা ব্রাহ্মণকন্যাদের বাহুবলে পরাস্ত করে ইসলাম ধর্ম কবুল করিয়ে স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করছেন।

ব্যাপারটি এতই পৌনপুনিকভাবে ঘটেছে যে মোহাম্মদ হানিফাকেও মনে হবে উনবিংশ শতাব্দীর একজন কুলীন হিন্দু-সন্তান, বিয়ে করে বেড়ানোই তাঁর একমাত্র পেশা। মোহাম্মদ হানিফা মস্ত বীর হলে কি হবে, অধিকসংখ্যক রূপসী স্ত্রীর সঙ্গে রতিরণ এবং ময়দান-রণ দুই-ই একসঙ্গে করতে হলে মাঝে মাঝে—এই সমস্ত ভয়ঙ্করী বীরাঙ্গনাদের হাতে—নাকালও হতে হয়। সেকালে বীরাঙ্গনাকে পরাজিত করতে পারলে স্বামী আর পরাজিত হলে থাকতে হত দাস হয়ে। সুতরাং মোহাম্মদ হানিফারও দুর্দশার অন্ত থাকে না। সংবাদ যায় হজরত আলির কাছে। বীর পুত্রের এসব কীর্তিকলাপ তিনি বিলক্ষণ সমর্থন করেন আর হৃদয়ে [তাঁর] অপত্যস্নেহও প্রচুর। হায়দারি হাঁক হেঁকে রণ-দামামা বাজিয়ে পুত্রের সাহায্যার্থে ছুটে আসেন [তিনি]। পুত্রকে শিখিয়ে পড়িয়ে একেবারে লায়েক করে সেই সমস্ত বিক্রমশীলা রমণীদের হার মানতে বাধ্য করান। তারপরে যুদ্ধকার্য সাঙ্গ হলে পিতাপুত্র দুজনে একই সঙ্গে দুটা বিবাহ করেন। পিতা যান দেশে ফিরে আর পুত্রবর প্রেমতৃষ্ণায় মাতাল হয়ে মরুভূমির ডন জুয়ানের মত নতুন নারীরতেœর সন্ধানে দেশে দেশে সফর করেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগের বীর এবং সাধুপুরুষদের নিয়ে যে সমস্ত পুঁথিপত্র লেখা হয়েছে তাতে তাঁদের ত্যাগ, ধর্মনিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় বিস্তর আদি রসাত্মক ব্যাপার-স্যাপারও স্থানলাভ করেছে। যে সকল ঐতিহাসিক চরিত্র পুঁথিলেখকেরা তাঁদের বিষয়ের উপজীব্য করেছেন, তাতে করে চরিত্রের ঐতিহাসিক সত্য সম্পূর্ণভাবে খেলাপ করে নিজেদের মনের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে একেবারে জবুথবু করে হাজির করেছেন। কল্পিত চরিত্র হলে তো কথাই নেই, আগাগোড়া রঙ্গ চড়িয়ে রঙ্গিলা না করে ছাড়েননি। তা করতে গিয়ে পুঁথিলেখকরা পরিবেশ সমাজ এবং সামাজিক সংঘাত [আর] মূল্যচেতনা দুই হাতেই দেদার ব্যবহার করেছেন।

যেমনÑধরা যাকÑকারবালা থেকে দামেস্কে যাওয়ার পথে কোন ব্রাহ্মণের বসবাসের বিষয়টি। তা তো একরকম জানা কথাই যে কোন ব্রাহ্মণের সেখানে নিবাস থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে কি হবে, পুঁথিলেখকের সেটি জানা থাকা চাই তো! কারবালা দামেস্কের মাঝপথে নয়, গোটা আরবদেশে ব্রাহ্মণ না থাকুক তাতে পুঁথিলেখকের কি আসে যায়! এই বাংলাদেশে তো ব্রাহ্মণ আছে। আর আমাদের পুঁথিলেখক ভদ্রলোকটি তো বাঙ্গালি এবং তিনি ব্রাহ্মণ জাতটার উপর হাড়ে হাড়ে চটা। সুতরাং অনায়াসে ব্রাহ্মণকে কারবালা দামেস্কের মাঝপথে বসিয়ে স্ত্রীপুত্রসহ সপরিবারে তাঁকে দিয়ে কলেমা পড়িয়ে মানসিক ঘৃণার মানসিক প্রতিশোধ নেয়া যায় এবং নিয়েছেনও [তিনি]।

ইতিহাসে হজরত আলিকে কম বিচক্ষণ বলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু তিনি মানুষ হিশেবে উদার মনের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর চরিত্র এমন নির্মল সুন্দর ছিল যে এখনো পর্যন্ত তাঁর গুণগ্রাম সর্বসাধারণের অনুকরণীয় বলে বিবেচনা করা হয়। পুঁথিলেখক তাঁকে শক্তি[মান] এবং বীর দেখাতে গিয়ে পশুশক্তিতে বলীয়ান হৃদকম্পসৃষ্টিকারী একজন প্রায় নারীলোলুপ মানুষের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

হযরত হামজা মদিনাতে ওহুদের যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন এবং হিন্দা নাম্নী জনৈকা কোরেশ রমণী যে তাঁর রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খেয়েছিল একথা সর্বজনবিদিত। তিনি জীবনে মক্কা-মদিনার বাইরে কোথাও গিয়েছেন কিনা সন্দেহ। পুঁথিলেখক তাঁকে শতাধিক বছর পরমায়ু দান করেছেন, কমপক্ষে অর্ধশত পত্নীর স্বামী [করেছেন], সে অনুপাতে পুত্রপৌত্রাদি উপহার দিয়েছেন। আমির হামজা হাজারখানেক যুদ্ধে বিজয়ী বীর, দেশদেশান্তরে তাঁর তো অবারিত গতায়াত, এমন কি দৈত্যের দেশ কোকাফে গিয়েও অসমসাহসিক কাজ সমাধা করে এসেছেন। এতেও পুঁথিলেখক তৎকালীন সমাজের প্রচলিত সংস্কার এবং শিল্পরুচির ব্যবহার করেছেন। হিন্দু-সমাজের বীরেরা যদি পাতাল বিজয় করে বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারেন, আমির হামজা দৈত্যের দেশে গমন করে তাদের শায়েস্তা করে আসতে পারবেন না কেন? ঐতিহাসিক চরিত্র হিশেবে মোহাম্মদ হানিফার মূলকাণ্ড কিছু নেই বলেই তো সুবিধা। কল্পনা যেভাবে ইচ্ছা বিচরণ করতে পেরেছে। হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ যদি বৃন্দাবনে ষোলশত গোপবালা নিয়ে লীলা করতে পারেন, মোহাম্মদ হানিফার কি এতই দুর্বল হওয়া উচিত যে মাত্র এ কয়টা ব্রাহ্মণকন্যা সামলাতে পারবেন না!

 

আহমদ ছফা বিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।