বাঙ্গালি মুসলমানের মন (মূল পাঠ ১৯৭৬)—৬

পলাশির যুদ্ধের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুসৃত নীতির ফলে [বাংলাদেশে] যে উঁচুকোটির মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণীটি ছিল তার অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। ভাষাগত দিক দিয়ে তারা বাঙ্গালি মুসলমান জনগণের সঙ্গে কোনরকমে সম্পর্কিত ছিলেন না। এ দেশে অনেকটা বিদেশির মতই অবস্থান করতেন। সরকারি চাকরিই ছিল তাদের এ দেশে অবস্থান করার মূখ্য অবলম্বন। নবাবি আমলের অবসানের পর যখন ইংরেজ শাসন কায়েম হল, তারা না পারলেন ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে, না পারলেন নিজেদের ধর্মীয় জনগণের নেতৃত্বদান করতে। রক্তগত, ভাষাগত, রুচি সংস্কৃতি এবং আচরণগত ব্যবধানের দরুন আপদকালে সমাজে নেতৃশ্রেণীর পালনীয় যে ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশে অবস্থানকারী অভিজাত মুসলিম শ্রেণীটির তা পালন করার কথা একবারও মনে আসেনি।

কিন্তু উত্তর ভারতে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টা। সেখানেও মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণীটি মোগল শাসনের আমলে সবদিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। অত্যল্পকাল গত না হতেই স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে তাঁরা নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়ার জন্য এবং নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য মনন এবং মানসিকতার পরিবর্তনে লেগে যান। তার ফলশ্র“তি আলিগড় কলেজ। এই কলেজের সবচেয়ে [বেশি] প্রণিধানযোগ্য যে অবদান তা হল মুসলিম নেতৃশ্রেণীকে পুঞ্জিভূত হতাশা থেকে উদ্ধার করে ব্রিটিশমুখী করা এবং ব্রিটিশ শাসকদেরও সিপাহি যুদ্ধের সংশয় সন্দেহের কুজ্ঝটিকা সরিয়ে মুসলিমমুখী করে তোলা।

এই ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ নিজে—তাঁর বন্ধু এবং অনুরাগীবর্গ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত আলিগড় কলেজ—বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। তাই সেখানে মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চাইতে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ছিলেন। আসলে স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে সুযোগ নেয়ার পদ্ধতিটা ভালভাবে শিখিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তা সারা ভারতের শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি শেকড় বিস্তার করেছিল যে আলিগড়ে শিক্ষিত মুসলমানেরা কদাচিৎ সুযোগসন্ধানী নীতি পরিহার করতে পেরেছিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদকে এজন্য আলিগড়ে শিক্ষিত মুসলমানদের মানসিকতার পরিবর্তন আনার জন্য প্রায় জেহাদ করতে হয়েছে। তথাপি তিনি সফল হয়েছেন একথা বলা চলে না। যাক, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

উত্তর ভারতে শাসক নেতৃশ্রেণী একটা সামাজিক নেতৃত্ব নির্মাণ করতে পেরেছিলেন কেননা জনগণ এবং অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি ও আচারগত শ্রেণীদূরত্ব ছাড়া অন্য কোন দূরত্ব ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত শ্রেণী একেবারে তলিয়ে গেল। কিন্তু অটুট থেকে গেল তাঁদের আচার-আচরণ, সামাজিক আদর্শ। হিন্দু সমাজের প্রতিযোগিতা এড়িয়ে ব্রিটিশ শাসকদের কৃপাকণা সম্বল করে যে সকল মুসলমান উপরের দিকে উঠে আসতেন [তাঁরা] মৃত মুসলিম অভিজাতদের আদর্শকেই নিজেদের আদর্শ বলে বরণ করে নিতেন। এঁরা আবার অনেক সময় আপন মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ যা করেছেন বাংলাদেশের মুসলমানের জন্য [নিজেদেরও] একই কাজ করা উচিত মনে করতেন।

হালের একগুঁয়ে ইতিহাস ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে প্রায়শ একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তারা বলে থাকেন, ব্রিটিশ শাসনের আমলে বাংলার মুসলমান সমাজ অধপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এটা পুরা সত্য তো নয়ই সিকি পরিমাণ সত্যও এর মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ। সত্য বটে, মুসলিম শাসনের অবসানের পর শাসক নেতৃশ্রেণীটির দুর্দশার অন্ত ছিল না। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সাধারণ বাঙ্গালি মুসলমান জনগণের একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোন যোগসূত্র ছিল কি? আর মুসলমান জনগণের অবস্থা ইংরেজ শাসনের পূর্বে অধিকতর ভাল ছিল কি? নবাবি আমলেও যে সকল ফারসি জানা এ দেশীয় কর্মচারী নিয়োগ করা হত, তাদের মধ্যে স্থানীয় হিন্দু কতজন ছিলেন এবং কতজন ছিলেন স্থানীয় মুসলমান, এ সকল বিষয় বিচার করে দেখেন না বলেই অতি সহজে অপবাদের বোঝাটি ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্বমুক্ত মনে করেন।

উত্তর ভারতেও মুসলিম শাসক নেতৃশ্রেণী এইভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অধিকন্তু তাঁদের অনেকেই সিপাহি বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপরেও তাঁরা কি করে এগিয়ে আসতে পারলেন এবং এবং তাঁদের মধ্যে কেন সৃষ্টি হল স্যার সৈয়দ আহমদের মত একজন মানুষ? বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে তেমন একজন মানুষ জন্মালেন না কেন? এই সকল বিষয়ে সদুত্তর সন্ধান করলেই বাঙ্গালি মুসলমানের যে মৌলিক সমস্যা তার মূলে যাওয়া যাবে।

 

আহমদ ছফা বিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।