জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতাসীন হন, তাঁকে অনেকদিন পর্যন্ত সামরিক শাসন জারি রাখতে হয়েছিল। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক খুনোখুনি তো ছিলই, সেনাছাউনিগুলোতেও সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তাছাড়া সীমান্তের ওপার থেকে চোরাগোপ্তা হামলা তাঁর সরকারকে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখে। সশস্ত্র পাহাড়িরা সীমান্তের ওপার থেকে দলবেঁধে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশকতামূলক কাজের আয়োজন করতে থাকে।
জিয়াউর রহমানের সরকার পুরো বিষয়টি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলেন। ভারতীয় সামরিক সাহায্যপুষ্ট পাহাড়িরা গেরিলারা যদি এভাবে ক্রমাগত হামলা পরিচালনা করতে থাকে, এমন একটা সময় আসা বিচিত্র নয়, যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে জিয়াউর রহমান দু’রকম পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করলেন। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র সেনাছাউনি বানালেন। দ্বিতীয়ত, সমতল ভূমি থেকে দরিদ্র বাঙ্গালি জনসাধারণকে নিয়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসনের ব্যবস্থা করলেন। রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেট দুর্বল সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্যে অন্য এলাকা থেকে ভিন্ন জনগোষ্ঠির মানুষ নিয়ে এসে অভিবাসনের ব্যবস্থা করতেন। একদিকে সেনাছাউনি স্থাপন এবং অন্যদিকে বাঙ্গালি জনগোষ্ঠির অভিবাসনকেই জিয়াউর রহমান পার্বত্য এলাকা বাংলাদেশের দখলে রাখার একমাত্র পন্থা বলেই অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই বাঙ্গালি জনগোষ্ঠির অভিবাসন পাহাড়ি জনগণের সে বিপুল অংশটিকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো, সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি যাদের কোন অনুরাগ কিংবা আস্থা ছিল না। দিনে দিনে পরিস্থিতি জটিল এবং ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকে।
জিয়াউর রহমানকে নানা ধরনের চাপের মুখে এ রকম একটি সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। তাঁর জানতে বাকি ছিল না, ভারতের তৎকালীন সরকারটি তাঁর প্রতি অনুকূল নয়। তাঁকে শারীরিকভাবে হত্যা করার একটি ষড়যন্ত্রের কথাও পরবর্তী সরকার ফাঁস করে দিয়েছিল। তারপরেও জিয়াউর রহমানের পক্ষে শেষরক্ষা সম্ভব হয়নি। আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানে তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের পর যখন এরশাদ ক্ষমতায় আসেন, পার্বত্য জনগোষ্ঠির বিক্ষোভ মোকাবেলা করার সেই সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একচুলও হেরফের হয়নি। এরশাদ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন। বেশকিছু রাস্তাঘাট বানিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠির প্রকৃত উন্নয়নের চাইতে সৈন্য বাহিনীর অবস্থান নিষ্কন্টক করা এবং তাদের অবস্থান ও চলাচলের সহায়তার জন্যে সেগুলো করা হয়েছিল বলেই অধিকাংশ পাহাড়ি জনগণ মনে করে থাকেন। এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের উন্নয়নের নামে পাহাড়ি এলাকায় তথাকথিত গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টি করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠি যেটুকু স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তাও হরণ করলেন। পার্বত্য অধিবাসীদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হলো।
বিগত বিশ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গলের আইন চালু রয়েছে। পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে। সেনাবাহিনীর লোকেরা পার্বত্য জনগোষ্ঠির ওপর অকথ্য নির্যাতন করেছে। অসংখ্য লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনাও অল্প নয়। পাহাড়িদের জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। শান্তিবাহিনীর লোকদের হাতেও সেনাবাহিনীর যথেষ্ট মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেক নিরীহ বাঙ্গালিও তাদের হাতে নিহত হয়েছেন। বিরোধ সেনাবাহিনী এবং শান্তিবাহিনীকে ছাড়িয়ে পাহাড়ি এবং বাঙ্গালি জনগোষ্ঠির মধ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি, বাঙ্গালি এবং সেনাবাহিনীর লোক মিলে কত মানুষ মারা গেছে তার সঠিক হিশেব পাওয়া যায়নি। কেউ বলছেন দশ হাজার, কেউ আরো বেশি।
খালেদা জিয়ার সরকারের আমল থেকেই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেনাবাহিনী মোতায়েন রখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটটির সমাধান সম্ভব নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। খালেদা জিয়ার সরকার একটি আপোষ প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। শেখ হাসিনার সরকার সেই আপোষ প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করে একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি সম্পাদন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আপোষ প্রক্রিয়াকে আমরা অভিনন্দিত করি।
খালেদা জিয়ার চাইতে শেখ হাসিনা অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। ভারতে বর্তমানে যে সরকারটি রয়েছে, তার সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক অধিক সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাছাড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মধ্যে একটা উপলব্ধি এতোদিনে নিশ্চয়ই এসেছে, ভারত নিজস্ব স্বার্থ ছাড়া চিরদিন তাদের দায়িত্ব বহণ করতে রাজি হবে না। মানুষ যেমন তার শরীরকে অতিক্রম করতে পারে না, তেমনি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির পক্ষে বাংলাদেশের বারো কোটি জনগণের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ দীর্ঘকাল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের শাসকদেরও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে—অত্যাচার, নির্যাতন করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠিকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। সবদিক বিবেচনা করে একথা অবশ্যই বলা যায়, একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশ বেঁচে দেয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছে, সেটা আমরা পুরো সত্য বলে মনে করিনে। তথাপি আমাদের কতিপয় সন্দেহ এবং আশঙ্কার কথা আমরা উচ্চারণ করতে চাই। অতীতে আওয়ামী লীগ ভারত সরকারের সাথে যে সকল চুক্তি করেছে, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। প্রথমত, বেরুবাড়ি হস্তান্তরের কথা উল্লেখ করি। চুক্তি সম্পাদনের সাথে সাথে বেরুবাড়ি ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু তিন বিঘার দখল পাওয়ার জন্যে বাংলাদেশকে পঁচিশ বছর সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ ক্ষুদ্র একটি দল ফরোয়ার্ড ব্লকের একজন কর্মী এই মর্মে হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছিল, তিনবিঘা বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। তারপরে একচল্লিশ দিনের ফারাক্কার ফিডারে ক্যানেল চালুর সম্মতি দেয়ার পর দেখা যাচ্ছে পঁচিশ বছর পরেও সেই একচল্লিশ দিনের মেয়াদ শেষ হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হাসিনা সরকার পানিচুক্তি সম্পাদন করলেন, এটাকে হাসিনা সরকারের একটা বিরাট সাফল্য হিশেবে প্রচার করা হলো। কিন্তু পরপরই এলো বন্দর সুবিধা এবং ট্রানজিটের দাবি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল, ভারতকে ট্রানজিট এবং বন্দর সুবিধা দিলে বাংলাদেশেরই লাভ। যাহোক ভারতের, সাথে পানিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু গত বছর আমরা পানি পাইনি। ভারতীয়দের কোন কোন কর্তাব্যক্তি আশ্বস্ত করছেন, এ বছর পানি পাওয়া যাবে। এ বছরও যদি ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকে, আমরা পানি পাব না, চুক্তি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জ্যোতি বসু তো বলেই দিয়েছেন ভুটানের সঙ্কোশী নদী থেকে খাল কেটে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে এবং সে পানি বাংলাদেশকে দিতে হবে। সঙ্কোশী নদী থেকে খাল কেটে পানি আনার প্রশ্ন যখনই উঠবে আবার জ্যোতি বাবুই বলবেন, রাজ্য সরকারের টাকা কোথায়, কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্দ করবেন, তারপর খাল কাটার কাজ শুরু হবে। ধরুন খাল কাটার অর্থ পাওয়া গেল, তারপর? পঞ্চাশটা এনজিও একযোগে আপত্তি উঠিয়েছে পরিবেশগত কারণে সঙ্কোশী নদী থেকে খাল কেটে পানি আনা অসম্ভব। অনুগ্রহ করে ওই এনজিওগুলো যদি আরেকটা মামলা ঠুকে দেয়, তাহলে বাংলাদেশকে তিরিশ বছরি চুক্তি কার্যকর করতে আরো তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে কি করবে তার একটা ধরাবাঁধা ছক আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সেই ছকের মধ্যে পড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। আমাদের ভারতের সাথে তো একটা সুসম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমরা কিভাবে আত্মরক্ষা করবো তার কোন ছক প্রণয়ন করা হয়নি। মেজর জেনারেল জেকব তাঁর বইতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, উদাহরণস্বরূপ সেটি তুলে ধরতে চাই। ঘটনাটি তাঁর জবানীতেই তুলে ধরছি। উনিশশো একাত্তর সালে কলকাতা এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ডি পি ধরের সাথে আমার সাক্ষাত ঘটে। আমি ডি পি ধরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা এখনো বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ট্রানজিট এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন না কেন? ডি পি ধর জবাবে বলেছিলেন, ‘আপনি সৈনিক মানুষ, রাজনৈতিক জটিলতা বুঝবেন না, ওগুলো একসময় আপনিই আমাদের হাতে এসে যাবে।’ আমি এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলাম, এই কারণে যে ট্রানজিট এবং বন্দর সুবিধা দেয়ার কথা আমরা পানি চুক্তি সময়েই শুনেছি। কিন্তু ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের উনিশশো একাত্তর সাল থেকেই সেগুলোর দিকে কড়া নজর ছিল।
একটু অপ্রাসঙ্গিক শোনালেও কথাগুলো এ কারণে বললাম, পাহাড়ি জনগোষ্ঠির সাথে যে কোন চুক্তি সম্পাদনের বেলায় ভারতীয় কূটকৌশলের ফাঁদে আমরা যেন জড়িয়ে না যাই। দুর্বল অবস্থানে দাঁড়িয়ে চুক্তি করলে ভারতকে ছাড় দিতে হবেই। ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অবস্থানের বিচারে আমাদের অবস্থান দুর্বল নয়। আমরা পূর্ব ভারতের স্বাভাবিক নেতা। সেই অবস্থানটি খাটো করে কোন চুক্তি সম্পাদন করলে, সেটা হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী—আওয়ামী লীগ সরকারকে এই কথাগুলো ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
২৩ নবেম্বর ১৯৯৭
শান্তি চুক্তি ও নির্বাচিত নিবন্ধ (ঢাকা: ইনফো পাবলিকেশনস্, ১৯৯৮)।