চট্টগ্রামের পার্বত্য অধিবাসীরা যদি স্বাধীনতা দাবি করতেন আমার এই রচনার বিষয়বস্তু এবং সুর অনেকখানি পাল্টে যেত। জনসংহতি পরিষদের নেতৃবৃন্দের বিবৃতি, বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা, এমনকি যে ভারত পার্বত্য অধিবাসীদের আশ্রয় দিয়েছে সেই ভারতীয় নেতাদেরও সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সকলে পার্বত্য অধিবাসীদের সংকট বাংলাদেশের সংবিধানের আওতার মধ্যে সমাধানের আলাপ-আলোচনা করছেন এবং ভবিষ্যতে যদি কোন চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাও সংবিধানের আওতার মধ্যেই হতে হবে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠি যদি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হতো না। যুদ্ধের মাধ্যমেই সবকিছুর নিষ্পত্তি করতে হতো। এখানে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের মার্কসবাদী রাজনীতির অনুসারীদের একাংশ মনে করেন, পার্বত্য অধিবাসীরা ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবন ধারণ পদ্ধতি—কোন দিক দিয়ে যেহেতু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সংযুক্ত নন, তাঁরা যদি মনে করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র অবস্থান করার কারণে তাঁদের মৌলিক অধিকারগুলো খর্ব হচ্ছে, তাঁদের আলাদা হয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাঁরা অক্টোবর বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার সংবিধানটির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এই ধরনের মতামত পোষণ করে থাকেন। আশা করি এতোদিনে তাঁরা জেনে গেছেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় সোভিয়েত রাশিয়ার মার্কসবাদী রাষ্ট্রের অস্তিত্বও গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। তাঁরা যেন একথাটি মনে রাখেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধিবাসীদের নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাঁদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বসবাস করতে হবে এবং বাংলাদেশীদের সুখ-দুঃখের শরিক তাঁদের হতে হবে। এটা তাঁদের দিক থেকে এবং আমাদের দিক থেকে খুবই আশার কথা। নতুন উপলব্ধির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁদের অধিকারগুলো অর্জন করতে সক্ষম হোন এবং এই দেশ, এই জাতিকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিমান করার কাজে তাঁদের প্রযতœ প্রযাস নিয়োজিত করুন সেটা হবে সবচাইতে উৎকৃষ্ট ব্যাপার।
মনে রাখতে হবে যেখানে চুক্তি করা হয়, চুক্তি ভঙ্গ করার একটি অবকাশও সেখানে থেকে যায়। আমরা আশা করবো কোন পক্ষ এমন কোন চাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করবেন না, যাতে অপরপক্ষ মনে করতে পারেন, তারা বঞ্চিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অশান্তি ডেকে আনতে পারে, এমন ক্ষণস্থায়ী শান্তিতে কোন পক্ষই লাভবান হতে পারবেন না, উদ্যামের অপচয় হবে শুধু।
প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তিটির রূপরেখা কি হতে পারে সে ব্যাপারে আমরা অন্ধকারেই থেকে গেছি। এটাও আমাদের দেশের নাগরিকদের একটা ভাগ্য বটে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যখন বেরুবাড়ি এবং তিনবিঘা ছিটমহল বিনিময়ের পাকা চুক্তি সম্পাদিত হলো, একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক হাইকোর্টে মামলা করে সেই চুক্তি পঁচিশ বছরের জন্যে ঠেকিয়ে দিলেন। আমাদের সরকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করেন, পার্লামেন্টে চুক্তি বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয় না, বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় না। নাগরিকদের সঙ্গে পরামর্শ সেতো অনেক দূরের ব্যাপার। শুধু বর্তমান সরকারের কথা বলছিনে, বর্তমান সরকারের আগের সরকার, তার আগের সরকার, সব সরকারের আমলেই এমনটি হয়ে আসছে। অথচ আমাদরে এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছি।
বিগত একমাস থেকে সরকার সমর্থক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির সমর্থনে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে আসছেন। কিন্তু জেনে রাখুন সরকার চুক্তির শর্তসমূহ সাধারণ্যে প্রকাশ করেনি। যে সকল ব্যক্তি চুক্তিতে কি আছে সে বিষয়ে কিছুই না জেনে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বসেন তাঁদের সামাজিক অবস্থান যাই হোক, কিছুতেই তাঁদের দায়িত্বশীল নাগরিক বলা যাবে না। নিজেদের সরকার বলে সেই সরকার ভুল করতে পারে না এমন যারা মনে করে বসেন তাঁদের সম্পর্কে অধিক বলার কি প্রয়োজন আছে?
প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তিতে কোন কোন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, পার্বত্য অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হচ্ছে কিনা, তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো রক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা, স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিলি-বণ্টন কিভাবে হবে, অভিবাসিত বাঙ্গালি অধিবাসীদের নিয়ে কি করা হবেÑএ সকল বিষয়ে সরকার কিংবা জনসংহতির নেতারা কোন রকম পূর্বভাষ দেননি।
চুক্তিতে কি থাকছে, না থাকছে, সেসব বিষযে কিছুই না জেনে আমি একটা সাহসী প্রস্তাব রাখতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটছে তার অংশিদার করা হোক। বাংলাদেশে যে ধনতান্ত্রিক বিকাশ ঘটছে আনুপাতিক হারে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের তার অংশ দেয়া না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কোনদিন সম্ভব হবে না। পার্বত্য জনগোষ্ঠির ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ চালানো হয়েছে তাই-ই সেখানকার জনগোষ্ঠিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং বিদ্রোহের পথে ধাবিত করে নিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, জাতিগত নিষ্পেষণের জন্ম দিয়েছে, জাতিগত নিষ্পেষণ সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণের পথ প্রশস্ত করেছে। একটা দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহণ, কলকারখানা, দোকানপাট ইত্যাদিতে যে পরিমাণ মূলধন বিনিয়োজিত আছে, তার শতকরা পাঁচভাগ মূলধনও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের কাছ থেকে আসেনি। পার্বত্য এলকার লোকদের হাতে যদি পর্যাপ্ত মূলধন থাকতো, তাঁরা যদি বাঙ্গালিদের মত সমগ্র বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারতেন, নিজেদের অবহেলিত, বঞ্চিত এবং প্রতারিত না ভাবতেন, তাহলে তাঁরা নিজেরা হাতে বন্দুক তুলে নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ করতেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে ক্যান্টনমেন্ট রাখার প্রয়োজন হতো না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সকল দাবি যদি মেটানোও হয়, তাঁরা ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ-প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে বিযুক্ত থাকেন, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে শান্তি কোনদিন প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাঁদের দারিদ্র তাঁদেরকে বিচ্ছিন্নতার পথে টেনে নিয়ে যাবে। প্রচলিত যে সকল পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সেগুলো পার্বত্য এলাকার শান্তি সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক হবে না।
সমতল ভূমির বাঙ্গালিরা পার্বত্য অধিবাসীদের যদি সত্যি সত্যি নিজের দেশের নাগরিক মনে করেন, তাঁদেরকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কর্তাব্যক্তিদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে চিন্তা করতে বলি। পার্বত্য অধিবাসীদের মূলধন সংগ্রহ করার জন্যে একটা ব্যাংক করা হোক। স্বাধীনভাবে তাঁদের মূলধন বিকাশের জন্যে অন্তত দশটা কোম্পানি গঠন করা হোক। অন্তত আগামী দশ বছর সেই কোম্পানিগুলোকে প্রোটেকশন দেয়া হোক। উদ্যমী তরুণদের সর্ববাংলা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করার জন্যে অবাধ সুযোগ দেয়া হোক। তাঁদের অনভিজ্ঞতা, কুণ্ঠা এবং সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে ব্যবসায়িক দক্ষতা যাতে অর্জন করতে পারে সে জন্যে বিজ্ঞ পরামর্শক সরবরাহ করা হোক। আমরা সমতল ভূমির মানুষের পার্বত্য অধিবাসীদের যদি সমান নাগরিক মনে করি, আমাদের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে, পার্বত্য অধিবাসীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার মত প্রতিভাবান ও যোগ্যব্যক্তি যদি থাকেন সেই ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হিশেবে মেনে নিতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।
অতীতে সংশয়, সন্দেহ, প্রতিরোধ, আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, অবিশ্বাসের ভিত্তিতে পার্বত্র চট্টগ্রামের ব্যাপক জনগোষ্ঠির মধ্যে যে প্রক্রিয়াগুলো চালু রয়েছে, সেই সংকটসমূহের সৃষ্টিশীল সমাধানের জন্যে একটা বড় ধরনের উল্লম্ফন প্রয়োজন। এই উল্লম্ফনটাকেই আমি অর্থনৈতিক উন্নয়নে পার্বত্য অধিবাসীদের অংশিদারিত্ব দান বোঝাতে চাইছি। পেছনের ইতিহাস ঘাটলে কোন সমাধান আসবে না। তাকাতে হবে সামনের দিকে। সংশ্লিষ্ট সকলকে একটা বিষয় বিবেচনা করার অনুরোধ করবো। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে যুদ্ধাবস্থা বজায় রেখে এ পর্যন্ত যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সেই অর্থটাই মূলধন হিশেবে পার্বত্য অধিবাসীদের প্রদান করা হলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ অনেকখানি প্রসারিত হবে।
৩০ নবেম্বর, ১৯৯৭
শান্তি চুক্তি ও নির্বাচিত নিবন্ধ (ঢাকা: ইনফো পাবলিকেশনস্, ১৯৯৮)।