ছফা পরিচিতি

আহমদ ছফা (১৯৪৩—২০০১) বাংলা জাতীয় সাহিত্যের সর্বশেষ আদর্শ। মজার জিনিশ এই যে কেহ কেহ জানিলেও এই কথাটি সকলে জানিতে পারেন নাই। কথাটি প্রচার করিবার দরকার আছে মনে করিয়া আমরা আহমদ ছফা বিদ্যালয় স্থাপন করিতেছি।

কথা উঠিবে, সাহিত্যের আবার আদর্শ কি। আহমদ ছফা বলিতেন আমাদের একালে—মানে বাংলায় এয়ুরোপিয়া শাসন প্রবর্তনের পরে—সাহিত্যের চারিটি আদর্শ। যথাক্রমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪—১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮—১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১—১৯৪১) আর কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯—১৯৭৬)। প্রস্তাবটির শেষে স্বয়ং আহমদ ছফার নামটিও এখন যোগ করা যায় বলিয়া আমরা মনে করিতেছি। কথাটা বুঝাইতে একটু সময় লাগিবে। আমরা চেষ্টা করিব বুঝাইতে। এই চেষ্টার নামই আমরা আহমদ ছফা বিদ্যালয় রাখিলাম।

মাইকেল, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ লইয়া কথা বাড়াইবার দরকার আর নাই। তবে নজরুল ইসলামের কথা লইয়া মনে হয় এখনও দুই চারি জায়গায় আপত্তি তোলা হয়। তাহার পরও বলা সম্ভব নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পর বাংলা সাহিত্যের মোড় ফিরিয়া গিয়াছে। তাঁহাকে অনেকেই যুগ-প্রবর্তক কবি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।

বাংলা জাতীয় সাহিত্যে নজরুল ইসলামের দান দুই প্রকারের। এক প্রকারে, তিনি বাংলা ভাষাকে নতুন জীবন দিয়াছেন। দ্বিতীয় প্রকারে তিনি বাংলার জাতীয় জীবনে নতুন সম্বিৎ ফিরাইয়া দিয়াছেন। একদিকে বাংলার মুসলমান সমাজে নতুন প্রাণের সঞ্চার করিয়াছেন, আবার আরেকদিকে বাংলা যে হিন্দু ও মুসলমানের দেশ সে কথা কদাচ বিস্মৃত হন নাই। তাই হিন্দু ও মুসলমান দুই সমাজকে একসঙ্গে জাগাইয়া তুলিবার ভার তিনি কবুল করিয়াছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম যে বছর বাকরুদ্ধ হইলেন, তাহার পরের বছর—১৯৪৩ সালে—জন্ম লইলেন আহমদ ছফা। নজরুল ইসলামের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রযুগের অবসান ঘোষণা করিয়াছিল। আর আহমদ ছফার যখন আবির্ভাব ঘটিতেছে—মানে ১৯৬০ সালের পরে—ততদিনে নজরুল যুগেরও অবসান হইয়া গিয়াছে, অথচ তুলনীয় কোন মহাপ্রতিভার উদয় হয় নাই। হয়তো মহাপ্রতিভার যুগই আর নাই। সাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ এনামুল হক ১৯৬৮ সালেও সাক্ষ্য দিতেছেন কাজী নজরুল ইসলামের মতো অসাধারণ প্রতিভাবান কবি এদেশে অচিরেই আবির্ভূত হইবেন আর এদেশের সাহিত্যে নতুন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনিবেন।

আমাদের দৃঢ় ধারণা আহমদ ছফার মধ্যে মুহম্মদ এনামুল হকের আশা কিছু পরিমাণে সত্য হইয়াছে। কিন্তু তিনি তাঁহাকে হয়তো সত্য চিনিতে পারেন নাই।

আহমদ ছফা রচনাবলীর সহিত যাঁহারা পরিচিত হইয়াছেন তাঁহারা লক্ষ্য করিবেন তাঁহার জন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রক্তধারার ভিতর। বিশ্বাস করিবেন তাঁহার সাধনা বাংলাদেশের জাতীয় সাধনার সহিত এক ধারায় মিশিয়াছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিম্বা নজরুল ইসলামের সহিত তাঁহার তুলনা করিব না। কিন্তু তিনিও বিচিত্রবীর্য লেখক ছিলেন। তাঁহার তপস্যাও নানান পথে সার্থক হইয়াছে। অন্য অনেক কিছু বাদ দিতে পারেন কিন্তু আহমদ ছফার উপন্যাস কাহিনীর মধ্যে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির যে রূপ ধরা পড়িয়াছে তাহা অনেক দিন ধরিয়া এ দেশের আকাশে আলো বিতরণ করিবে।

আহমদ ছফার সাধনা সম্পূর্ণ বিফলে যায় নাই। আজ তাহার প্রমাণ নতুন জাতির জীবনে নানান ভাষায় নানান ভাবে ছড়াইয়া পড়িতেছে। তাঁহাকে নিরবতার শান্তিতে ঘুমাইয়া থাকিতে নির্দেশ দিয়াছেন এ দেশের শাসকশ্রেণি। আমরা সে দেশনা মানিব না। আমরা ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মত চুপ করিয়া থাকিব না।

আমরা তাঁহার কবরের শান্তিতে আঘাত করিব। আহমদ ছফা বিদ্যালয় সেই কোলাহল হইতে নতুন নতুন জন্ম লইবে। আমাদের জাতীয় সাহিত্যের সর্বশেষ আদর্শ হইতেই আমরা নতুনভাবে জন্মাইব॥