যেহেতু নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশির ভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে একটা বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিল, বর্ণাশ্রমধর্মের কড়াকড়ির দরুন ইসলাম কিংবা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধেও তাঁদের মনে কোন ধারণা জন্মাতে পারেনি। পাশাপাশি ইসলামও যে একটা উন্নত দীপ্তধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিশেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সংসাধন করেছিল, বাঙ্গালি মুসলমানের মনে তার কোন গভীরাশ্রয়ী প্রভাব পড়েনি বললেও চলে।
প্রথমত ভারতে ইসলাম প্রচারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফি দরবেশদের একটা গৌণ ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু লোদি, খিলজি এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্যবিস্তারই যে ইসলাম ধর্মের প্রসারের মুখ্য কারণ তাতে কোন সংশয় নেই। এই পাঠান মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক এক বস্তু ছিল না। আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে বাগদাদে, ফাতেমীয় খলিফাদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলিফাদের আমলে স্পেনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল, ভারতবর্ষে তা কোনদিন প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের যে অপ্রতিহত প্রভাব ইউরোপীয় রেনেসাঁস সম্ভাবিত করে তুলেছিল ভারতের মাটিতে সে যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা একেবারেই শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া, সঙ্গীতকলা, স্থাপত্যশিল্প, উদ্যান রচনা এবং ইরান তুর্কিস্থান ইত্যাদি দেশের শাসনপদ্ধতি এবং দরবারি আদব-কায়দা ছাড়া অন্য কিছু ভারতবর্ষ গ্রহণ করেনি।
তদুপরি এই ভারতবর্ষের লক্ষেèৗ দিল্লি ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলামের যেটুকু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে বাংলা মুলুকে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছাতে পারেনি। যে মুসলিম শাসকশ্রেণীটি নানা সময়ে বাংলাদেশ শাসন করতেন তাঁরা সকলেই ছিলেন বিদেশি। রক্ত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোন সম্পর্ক ছিল না। অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মত সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তাঁরা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক ফ্যাশান ইত্যাদির জন্য দিল্লি কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন। এই উঁচুকোটির মুসলিম শাসকবর্গ—যাঁদের হাতে অধিকাংশ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল তাঁরা—স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক নেতা ছিলেন না। এই উঁচুকোটির মুসলমান প্রশাসকেরা এদেশীয় যে শ্রেণীটির সহায়তায় বাংলাদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন স্থানীয় উঁচুবর্ণের বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈশ্যশ্রেণীর লোক। যখনই প্রয়োজন পড়েছে কিংবা ব্রাহ্মণশ্রেণীর আনুগত্য সম্বন্ধে মনে সন্দেহ জেগেছে [তখনই] তাঁরা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে—খেলাত এবং পদবি বিতরণ করে—আরেকটি নেতৃশ্রেণী সৃষ্টি করেছেন। ‘খাসনবিশ’, ‘মহলানবিশ’, ‘দেওয়ান’, ‘রায়রায়ান’, ‘বখশি’, ‘মুন্শি’, ‘দস্তিদার’ ইত্যাদি পদবিতেই তার প্রমাণ মেলে।
বাংলার স্থানীয় মুসলমানেরা কদাচিৎ বিদেশি মুসলমান শাসকদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মে সহায়তা করার সুযোগ লাভ করেছেন। তার কারণ ছিল একটি রাজশক্তির সঙ্গে সহায়তা করার জন্য যে পরিমাণ নিরাপদ আর্থিক ভিত্তির প্রয়োজন বাঙ্গালি মুসলমানদের তা ছিল না। মুসলিম রাজশক্তি এই দেশের সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অতি সামান্যই রূপান্তর এনেছিলেন। তাঁরা অনেকটা নির্বিবাদেই পূর্বতন সমাজ-কাঠামো গ্রহণ করেছিলেন। পরিবর্তন ততটুকুই করেছিলেন যতটুকু তাঁদের প্রয়োজন অর্থাৎ পূর্বেকার শাসক নেতৃশ্রেণীর শূন্যস্থানটি তাঁরা পূর্ণ করেছিলেন। মুসলিম শাসনের পূর্বে যে সমাজ-ব্যবস্থাটি চালু [ছিল] তার মধ্যে কোন মৌলিক রূপান্তর বা পরিবর্তন তাঁরা আনতে পারেননি। তাই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পরেও স্থানীয় মুসলমানেরা ইংরেজ আমলের দেশি খ্রিস্টানদের মত একটা উন্মত্ত গর্ববোধ ছাড়া ইসলাম কিংবা আর্য-সংস্কৃতির কিছুই লাভ করতে পারেনি।
তাই খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মুসলমান আমলেও যারা প্রশাসনিক প্রয়োজনে ফারসি ভাষা শিক্ষা করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের উঁচুবর্ণের লোক। বাঙ্গালি মুসলমানদের অবস্থার, পেশার এবং রুচির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ইসলাম গ্রহণের ফলে তারা কতিপয় মোটা অভ্যাস বর্জন করে কতিপয় মোটা অভ্যাস গ্রহণ করেছিলেন। সংখ্যাগত দিক দিয়ে তারা ছিলেন অনেক, উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি ছিলেন সম্পর্কিত এবং রাজশক্তি সময়ে অসময়ে তাদের প্রতি আনুকূল্যও প্রদর্শন করতেন—এই সকল কারণের দরুন তাঁদের মধ্যে দ্রুত একটা সামাজিক আকাক্সক্ষা জন্মলাভ করেছিল। পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে এই আকাক্সক্ষাই পূর্ণদৈর্ঘ্যে মুক্তিলাভ করেছে।
আহমদ ছফা বিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪
ভীষণ ভালো লাগলো। নতুন কিছু তথ্য জানতে পারলাম।