বাঙ্গালি মুসলমানরা শুরু থেকেই তাঁদের আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিলেন। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তনের কারণে তাদের মধ্যে একটা সামাজিক প্রভুত্ব অর্জনের আকাক্সক্ষার উন্মেষ হলেও [তাদের] জাগতিক দুর্দশার অবসান ঘটেনি। বাংলাদেশে নতুন নতুন রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আশাতীতহারে বৃদ্ধিলাভ করেছে। যেহেতু মৌলিক উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে কোন পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেনি, তাই রাজশক্তিকেও পুরানা সমাজ সংগঠনকে মেনে নিতে হয়েছে। সেজন্যই মুসলিম শাসনামলেও বাঙ্গালি মুসলমানেরা রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিগৃহীত ছিলেন। ইংরেজ আমলে উঁচুশ্রেণীর মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে সামাজিক নেতৃত্বের আসন থেকে বিতাড়িত হলে উঁচুবর্ণের হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই সে আসন পূরণ করে।
বাঙ্গালি মুসলমানদের অধিকাংশই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের লোক। তাঁদের মানসিকতার মধ্যেও আদিম সমাজের চিন্তনপদ্ধতির লক্ষণসমূহ সুপ্রকট। বারবার ধর্ম পরিবর্তন করার পরেও বাইরের দিক ছাড়া তাঁদের বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলবস্তুর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। দিনের পর দিন গিয়েছে, নতুন ভাবাদর্শ এদেশে তরঙ্গ তুলেছে, নতুন রাজশক্তি এদেশে নতুন শাসনপদ্ধতি চালু করেছে, কিন্তু তাঁরা মনের দিক দিয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের মতই বারবার বিচ্ছিন্ন থেকে গিয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই ছিলেন বাঙ্গালি মুসলমান এবং মুসলমান রাজত্বের সময়ে তাদের মানসে যে একটি বলবন্ত সামাজিক আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তাঁদেরই রচিত পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। কাব্য-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে হয়ত এসকল পুঁথির বিশেষ মূল্য নেই কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমান সমাজের নৃতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায় এসবের মূল্য যে অপরিসীম সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতালীয় দার্শনিক বেনেদেত্তো ক্রোচের মতে, প্রতিটি জাতির এমন কতিপয় সামাজিক আবেগ আছে যার মধ্যে জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্যাসের আকারে পুরামাত্রায় বিরাজমান থাকে, রাজনৈতিক পরাধীনতার সময়ে যে আবেগ সাপের মত কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে এবং কোন রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে সে আবেগই ফণা মেলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। সাহিত্যেই প্রথমে এই জাতিগত আকাক্সক্ষার রূপায়ন ঘটতে থাকে। জাতিগত আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে কোন মহৎ সাহিত্য যে সৃষ্টি হতে পারে না একথা বলাই বাহুল্য।
পুঁথিসাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙ্গালি আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে। কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার, সে মন কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতাসমূহ সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই বিরাজমান ছিল। সমাজ-সংগঠন ভেঙ্গে ফেলে নব রূপায়ন তারা ঘটাতে পারেননি। কারণ মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে যে নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন তাদের মধ্যে বাঙ্গালি মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব একেবারে ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুন শাসকশ্রেণীর অভ্যাস মনন রপ্ত করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙ্গালি মুসলমান। ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পরে এই দেশে হিন্দুসমাজের ভেতর থেকে যে একটি মধ্যবিত্ত নেতৃশ্রেণী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার মধ্যে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব প্রায় না থাকার কারণ হিশেবে শুধু ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি কিংবা মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ইংরেজের অন্ধবিদ্বেষকে ধরে নিলে মুসলিম সমাজের তুলনামূলকভাবে পেছনে পড়ে থাকার কারণসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা করা হবে না।
আহমদ ছফা বিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর-নবেম্বর ২০১৪