মুক্তিযুদ্ধের ওপর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিশুদ্ধ বই আমি দেখিনি

সাহিত্য এদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামকে কিভাবে, কতটুকু অনুপ্রাণিত করেছে বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক বড় বড় লেখকের লেখা বই আমি পড়েছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ওপর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিশুদ্ধ বই দেখিনি। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের  আওয়াজ  পাওয়া যায়’ নাটকটির কথা বলা যায়। এটি মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা। কাঠামো ও আঙ্গিকের দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু প্রাণ প্রবাহের দিক থেকে সেটা ব্যর্থ। মনে হয়, এটি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লেখা। কিন্তু নাটকটি অবশ্যই একটি শাণিত লেখা। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস পড়েছি। যুদ্ধের সময়কার একটি বস্তিকে নিয়ে লেখা যে উপন্যাস। সাহিত্যে এই উপন্যাসটির স্থান কোথায় হবে জানি না। কিন্তু উপন্যাসটির মানবিক আবেদন আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের সাহিত্যকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ এদেশের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সম্ভবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। কেননা, স্বাধীনতার আগে আমাদের সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ছিল ত্রিকোণাকৃতির প্রেম। এ ধরনের ছকেই রচিত হত গল্প-উপন্যাস। যার ফলে শওকত ওসমানের মত সাহিত্যিককেও বাগদাদের কাহিনী নিয়ে লিখতে হয়েছে ‘ক্রীতদাসের হাসি’। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ সেই ধারাকে ভেঙ্গে ফেলেছে।

অথচ মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে লেখা সাহিত্যে যুদ্ধের জীবন অনুপস্থিত। আসলে যুদ্ধের শুরু কিভাবে, কারা ভারতে গেলো, কিভাবে গেলো, শরণার্থী শিবিরে কারা কিভাবে ছিলো? কারা শরণার্থী শিবিরে ছিলো না, কারা থিয়েটার রোডে ছিলো কিংবা কারা ঘরে ফিরে এলো, কারা ফিরতে পারলো না — সে সব বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করে একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে মনে করে একটি কল্পনার নায়ক বানিয়ে, পাকবাহিনীকে কষে গাল দিলে, দু’একজন ধর্ষিতা বোনের চিত্র অংকন করলে একটি যুদ্ধের সাহিত্য রচনা করা যায় — এ রকম একটা অপচেষ্টা আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। এই প্রবণতা সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না।

আমি আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থাকে ধারণ করে সত্যিকার সাহিত্য রচনা এখনো হয়নি। আমার ধারণা, ১৫ বছর সময় যথেষ্ট নয়। ‘ওয়ার এন্ড পিসের’ মতো গ্রন্থ যুদ্ধের পরপরই রচিত হয়নি — হয়েছে অনেক পরে। সুতরাং এ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন সাহিত্যে না ঘটলেও, ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না আমি তা মনে করি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো একটি গৌরবময় সংগ্রাম যেহেতু আমাদের জাতীয় জীবনে এসেছে সুতরাং সে রকম সাহিত্যও রচিত হবে — এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী।

 

উৎস: ‘সচিত্র স্বদেশ’ [আনুমানিক প্রকাশকাল ১৯৮৬], পৃ. ৫৩

পুনর্মুদ্রণ: সর্বজন, নবপর্যায় ১৯, ৩১ জুলাই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।